প্রকাশিত হয়েছে “বিশ্বখ্যাত মনীষীদের রচনায় ইসলামী আইন” (১ম ও ২য় খণ্ড)

06:00:00

1608 বার পঠিত


প্রকাশিত হয়েছে “বিশ্বখ্যাত মনীষীদের রচনায় ইসলামী আইন” (১ম ও ২য় খণ্ড)

বিশ্বখ্যাত মনীষীদের রচনায় ইসলামী আইন
সম্পাদনা পরিষদ কর্তৃক সম্পাদিত

প্রথম প্রকাশ : মে -২০১৭

প্রকাশকের কথা
আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ তাআলার অশেষ মেহেরবানীতে “বিশ্বখ্যাত মনীষীদের রচনায় ইসলামী আইন” শীর্ষক দুখ-ের রচনাবলি ছাপার কাছ সম্পন্ন হয়েছে। প্রকাশনার এই শুভলগ্নে এ কাজে জড়িত সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্যে উত্তম প্রতিদান কামনা করছি।
এই দুনিয়াটা যেমন এমনিতে অস্তিত্ব লাভ করেনি, তদ্রুপ উদ্দেশ্যহীনভাবেও এই ভূম-ল ও নভোম-ল সৃষ্টি করা হয়নি। মহান আল্লাহ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় দুনিয়া ও মানব সভ্যতা সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং দুনিয়ায় তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য ঘোষণা করেছেন।
দুনিয়ায় মানবম-লী যাতে মহান স্রষ্টাকে বিস্মৃত হয়ে বিপথে চলে না যায় সেজন্যে আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উত্তরাধিকারী হিসেবে উলামায়ে কিরাম তথা মুসলিম স্কলারগণ সেই নবীওয়ালা দায়িত্বের ভার বহন করছেন। তাঁরাই যুগে যুগে মানবম-লী বিশেষ করে মুসলিম উম্মাহকে আল্লাহর উদ্দেশ্য অনুযায়ী জীবন পরিচালনার জন্যে তাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও দিকনির্দেশনা লিখনীর মাধ্যমে অবহিত করেছেন। যেগুলোকে কেন্দ্র করে দেশে দেশে গড়ে ওঠেছে নানান একাডেমিক ইন্স্টিটিউশন।
বর্তমান বিশ্বে ইসলাম ও মুসলমানদের নিয়ে যতোটা প্রচার-প্রচারণা, বাক-বিত-া হয়, অন্য কোন ধর্মমত কিংবা মতাদর্শ ও অনুসারীদের নিয়ে আলোচনা সমালোচনা ততোটা সরগরম নয়। বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ। প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও বাস্তবতার মানদ-ে যাচাই এবং নিরীক্ষার যুগ। যুক্তি প্রমাণ ও বিষয়জ্ঞান ছাড়া কারো বক্তব্য বর্তমান যুগে গ্রহণযোগ্যতা পায় না।
এ প্রেক্ষিতে ইসলামী আইন সম্পর্কে বিশ্বের স্বীকৃত ব্যক্তিদের চিন্তা ও রচনাবলি বাংলায় প্রকাশ করার মাধ্যমে চিন্তাশীলদের দৃষ্টি আকর্ষণের আশা করছি। যতদিন আমাদের দেশে ইসলাম সম্পর্কে সামগ্রিক অধ্যয়ন ব্যাপকতা না পাবে, ততোদিন এ সম্পর্কিত সামাজিক বিভ্রান্তির অপনোদন সম্ভব নয়। ইসলামী আইনের কল্যাণ, স্থায়িত্ব ও সৌন্দর্য জনসম্মুখে বিকশিত করতে হলে অবশ্যই আমাদের খোলা মনে উদার দৃষ্টিতে ইসলামের মর্মবাণী গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে হবে। এ গ্রন্থে পরিবেশিত খ্যাতিমান মনীষীদের রচনাবলি ইসলাম সম্পর্কে জানার ও গভীরে পৌঁছার পথ দেখাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর নির্দেশাবলি অনুধাবন ও অনুসরণের তাওফীক দিন। আমিন।

এডভোকেট মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম
জেনারেল সেক্রেটারি

মুখবন্ধ
সংবিধান, আইন ও নেতৃত্ব-এ তিনটি ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে একটি রাষ্ট্রযন্ত্র কার্যকর ভূমিকা পালন করে। সংবিধান রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে, আইন রাষ্ট্রের নাগরিকদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক কৃষ্টি-কালচার এবং লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জনের পথ রচনা করে, আর নেতৃবর্গ রাষ্ট্রের সার্বিক কর্মযজ্ঞ তথা উন্নয়ন অগ্রগতিতে চালকের ভূমিকা পালন করে রাষ্ট্রের সার্বিক শক্তি সামর্থকে লক্ষ্য উদ্দেশ্য অর্জনে সম্পৃক্ত করে। রাষ্ট্রের এ তিনটি মৌলিক বিষয়ে ইসলাম যে মূলনীতি দিয়েছে তা সবচেয়ে উন্নত, টেকসই এবং মানবতার কল্যাণের নিশ্চয়তা দেয়।
আইন সম্পর্কে যে কোন মুসলিমের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন। কারণ ইসলাম মানুষের গোটা জীবনটাকেই এক ও অভিন্ন তাওহীদের ছাঁচে গড়ে তুলতে চায়। আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর রাসূল স. মানবজীবনের জন্য যে বাস্তবভিত্তিক জীবনপদ্ধতি প্রবর্তন করেছেন, এটাকেই বলা হয় ইসলামী আইন। ইসলামী আইন জীবনের সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, দেওয়ানী, ফৌজদারী, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সকল আইনের ক্ষেত্রেই ইসলামের রয়েছে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং নীতি আদর্শ।
ইসলামী আইন সর্বজনীন ও সামগ্রিক। ইসলামী আইন জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানবজীবনের সবকিছু পরিচালিত করে। প্রত্যেক মুসলমান তার সমগ্র জীবন ইসলামী আইনের আলোকে পরিচালিত করবে, এটাই ঈমানের দাবি। মুসলমানদের জন্য ইসলামী আইন শুধু শাস্ত্রীয় মতাদর্শিক বিষয় নয়, মুসলিম সমাজে ইসলামী আইন একটি প্রাণবন্ত চেতনা। ইসলামী আইন তাদের প্রাত্যহিক জীবনাচারে প্রতিফলিত হয়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে এবং বিগত প্রায় পনেরো শতাব্দি ধরে মুসলিমদের জীবন গঠন করে আসছে এবং এখনও করছে।
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা এবং অবিভাজ্য আদর্শ। ইসলামে জাগতিক, রাজনৈতিক ও মাযহাবী মতপার্থক্য  থাকলেও পারলৌকিক বিশ্বাস সম্পর্কে কোন মতপার্থক্য নেই। কেয়ামত পর্যন্ত ইসলাম প্রথম দিনের মতোই সতত সজীব ও কার্যকর, যদি রাষ্ট্রযন্ত্র ইসলামী আদর্শকে পরিপালন করে এবং ইসলামী আইনের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। রাষ্ট্রযন্ত্র যদি ইসলামী আদর্শের লালন ও সুরক্ষা নিশ্চিত না করে, তাহলে ইসলামী আইন তার সর্বজনীন কল্যাণের প্রতিফলন ঘটাতে পারে না। এ কথাই মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ স. এর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছেÑ
الإسلام والسلطان إخوان توأمان لا يصلح واحد منها إلا لصاحبه، فالإسلام أس والسلطان حارس وما لا اس له يهدم وما لا حارس له ضائع.
 “ইসলাম ও শাসনযন্ত্র একই মায়ের যমজ ভাই। একজনকে ছাড়া অন্যজন সঠিকভাবে চলতে পারে না।” ইসলামকে যদি একটি স্থাপনা মনে করা হয় তবে শাসনযন্ত্র হলো এর সুরক্ষা। কোন স্থাপনা যদি দুর্বল হয় সেটি যেমন ধসে পড়ে, তদ্রƒপ সুরক্ষা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা না থাকলে যে কোন স্থাপনা লুটতরাজের শিকার হয়।” (জামিউল আহাদিস লিস সুয়ূতী; কানযুল উম্মাল)
মুসলমানদের দুর্ভাগ্যের কারণ হলো, তারা অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। যাদের উপর ইসলামের সুরক্ষার দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল, তারা উম্মাহর জীবনাদর্শের সুরক্ষা দেয়া তো দূরে থাক, নিজেদেরই রক্ষা করতে পারেনি। ফলে ইসলাম নামের প্রাসাদটিতে লুটেরা ও আগ্রাসীরা যে যার মতো করে বিকৃতি সাধন করেছে, দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ বদলে গেছে ইসলামের অবয়ব। অথচ মুসলিম উম্মাহ ছিল ঐক্যবদ্ধ ও অবিভাজ্য; সেখানে এখন শতধা বিভক্তি, সহমর্মিতা ও সহিষ্ণুতার জায়গাগুলো এখন মতপার্থক্য ও দ্বন্দ্ব সংঘাতে জর্জরিত।
ইসলাম মানুষের গোটা জীবনটাকেই ইসলামী আদর্শে পরিচালনার দাবি করে। ইসলামী আইন ব্যক্তিগত আচার অনুষ্ঠানের বিষয় নয়। ব্যক্তিগত জীবনের মতো সামাজিক জীবনে ইসলামের বিধান পালনের বিষয়টিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। কেননা সমাজ থেকেই ব্যক্তি ইসলামী অনুশাসন পালনে উৎসাহিত হয় এবং অনুপ্রেরণা লাভ করে। সামাজিকভাবেই মানুষ কল্যাণকর কাজকর্মের প্রতি উজ্জীবিত হয়, যার ফলে প্রত্যেক নাগরিক সুখী ও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। এ কথাটাই ঈসা আ. বলেছেন- “একটি সমাজে যখন আল্লাহর বিধান প্রতিপালিত হয় তখন আসমান সেখানে বরকত বর্ষণ করে, আর যমীন তার গর্ভে থাকা সকল সম্পদ ভা-ার উগড়ে দেয়।”
মহান আল্লাহ বলেন :
يٰۤا اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً ط وَلَا تَتَّبِعُوْا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ ـ
“তোমরা ইসলামে পরিপূর্ণ প্রবেশ করো, শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না।”
(সূরা বাকারা : আয়াত ২০৮)
কুরআন নবী রাসূলদের আগমনের উদ্দেশ্য বর্ণনায় বলেছে, আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতে আল্লাহর নির্দেশমতো ইনসাফ প্রতিষ্ঠা ও মানুষকে পথনির্দেশের জন্য নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন। ইসলামকে জাগতিক জীবনে পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকার জন্যে প্রেরণ করা হয়নি; বরং বিজয়ী হওয়া ও প্রভাবিত করার জন্যেই ইসলাম দুনিয়াতে এসেছিল। মহান আল্লাহ বলেন :
لَقَدْ اَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَاَنْزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ وَاَنْزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيهِ بَاْسٌ شَدِيْدٌ وَّمَنَافِعُ لِلنَّاسِ.
“আমি আমার রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি স্পষ্ট প্রমাণসহ এবং তাদের সাথে দিয়েছি কিতাব ও ন্যায়নীতি, যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে। আমি লোহা দিয়েছি যাতে রয়েছে প্রচ- শক্তি ও রয়েছে মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ।”
(সূরা আল-হাদীদ : আয়াত ২৫)
মহান আল্লাহ আরো বলেন :
هُوَ الَّذِيۤ اَرْسَلَ رَسُوْلَهٗ بِالْهُدَى وَدِيْنِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهٗ عَلَى الدِّيْنِ كُـلِّه وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ.
“তিনিই তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন হিদায়াত ও সত্য দীনসহ, সব দীনের উপর তাকে বিজয়ী করার জন্য, যদিও মুশরিকরা তা অপসন্দ করে।”
(সূরা আস-সাফ্ফ : আয়াত ৯)
মহান আল্লাহ আরো বলেন, إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ. “বিধান শুধু আল্লাহর।”
(সূরা ইউসুফ : আয়াত ৪০)
أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ  “জেনে রাখ, সৃষ্টি যার আইনও তার।” আল্লাহ তাআলার দেয়া আইন অগ্রাহ্য করে যারা অন্য আইন প্রতিপালন করে তাদের আল্লাহ জালেম, কপট ও বিরুদ্ধাচারী ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন :
يَحْكُمْ بِمَا اَنْزَلَ اللّٰهُ فَاُوْلٰٓئِكَ هُمُ الْكٰفِرُوْنَ .. فَاُوْلٰٓئِكَ هُمُ الظَّالِمُوْنَ... فَاُولٰٓئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ.
“আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না তারাই বিরুদ্ধাচারী... তারাই জালিম... তারাই ফাসিক।” (সূরা আল-মায়িদা : ৪৪, ৪৫, ৪৭)
উপরের নির্দেশগুলোতে এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে ওঠে, ইসলামের মৌল দাবিগুলোর অন্যতম একটি হলো ইসলামী আদর্শ ও মূল্যবোধের লালন পালনের দায়িত্ব বর্তাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর এবং রাষ্টের আইন ইসলামের নীতি আদর্শের ভিত্তিতে রচিত হবে। এমনটি যেখানে অনুপস্থিত সেখানকার সমাজ নামে মুসলিম হলেও বাস্তবে ইসলামী আদর্শ থেকে বিচ্যুত। ফলে ইসলামী সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ ও বরকত থেকে সে সমাজ বঞ্চিত। শুধু তাই নয়, সে সমাজ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও তারা শতধা বিভক্ত, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও কলহে লিপ্ত হয়ে হীনবল এবং ক্ষয়প্রাপ্ত।
এমন স্ববিরোধিতা কিভাবে সম্ভব, কোন ভূখ-ের মানুষ এক আল্লাহতে বিশ্বাস করবে, অথচ প্রাত্যহিক কাজকর্মের মাধ্যমে তারা আল্লাহর বিধানের বিরোধিতা করবে? তারা ব্যক্তিগত জীবনে আল্লাহর বিধান মান্য করবে, অথচ সামাজিক জীবনে আল্লাহর নাফরমানী করে অমুসলিম কাফেরদের অনুসরণ করবে?
কোন জাতি উন্নতি করতে পারে না যতোক্ষণ সে জাতির সিংহভাগ মানুষ পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে সীসাঢালা ঐক্যের প্রাচীর রচনা না করে। একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত জাতিরাষ্ট্র গঠনে অন্তত মৌলিক কিছু বিষয়ে দৃঢ় ঐক্য স্থাপন ছাড়া কাঙ্খিত ফল পাওয়া সম্ভব নয়। মৌলিক বিষয়ে যদি কোন জাতি সুদৃঢ় ঐক্য গড়তে ব্যর্থ হয়, তবে সে জাতির সত্যিকার উন্নতি অগ্রগতি অসম্ভব। ঐক্যের অনুপস্থিতিতে অনৈক্য ও দ্বন্দ্ব সংঘাত জাতিকে ভেতর থেকে ফোকলা করে ফেলবে, পারস্পরিক সংঘাত সংঘর্ষ জাতীয় শক্তি নষ্ট করে ফেলবে এবং গোটা জাতিটাই একসময় ধ্বংসের অতল তলে নিমজ্জিত হবে।
মুসলিম সমাজব্যবস্থা আল্লাহ ও রাসূল স.-এর দেয়া আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অধীনে আমাদের প্রায় দুশ বছর অতিবাহিত হলেও এখনো সমাজের সৌন্দর্য এবং মূল্যবান যে উপাদানগুলো অক্ষুণœ আছে সবগুলোই ইসলামের অবদান ও ইসলামী আদর্শ অনুসরণের ফল।
বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, আদর্শ ও মতবাদের প্রভাবে এ দেশের মুসলমানদের মধ্যে সমাজ, রাষ্ট্র, শিক্ষা, সংস্কৃতি ইত্যাকার বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেও ঐক্যের বন্ধন যতোটুকু অবশিষ্ট আছে, এর সবটুকুই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল স.-এর প্রতি বিশ্বাসের অবদান। দেখা গেছে, আল্লাহ ও রাসূল স.-এর ব্যাপারে যখনই কোন দুরাচার অমর্যাদাকর কোন কিছু ঘটিয়েছে, তখন শত মতভেদ ভুলে সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠী ঐকতানে একই সারিতে একতাবদ্ধ হয়েছে। তদ্রুপ ইসলামের নামে বিভ্রান্ত উগ্র গোষ্ঠী যখন নির্বিচারে জিহাদের নামে মানুষ হত্যায় মেতে ওঠেছে, এ ক্ষেত্রেও দেশের মানুষ দলমত নির্বিশেষে একতাবদ্ধ হয়ে এর প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে।
বাংলাদেশে ইসলাম সম্পর্কে গভীর পড়াশোনা ও চিন্তা গবেষণার অভাব রয়েছে। এখানকার শিক্ষা কারিকুলামে ইসলাম যতোটুকু আছে তা আধুনিক আইনের সাথে তুলনা করে ইসলামী আইনের সর্বজনীন কল্যাণ ও স্থিতিশীলতা প্রমাণের মতো প্রজ্ঞাবান গবেষক তৈরির জন্যে মোটেও সহায়ক নয়। তা ছাড়া ইসলাম সম্পর্কে গবেষণায় আগ্রহী হওয়ার মতো উদ্ধুদ্ধকরণের কোন ব্যবস্থাও নেই। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলাম অনেকটাই গ-িবদ্ধ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এর ফলে ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা বেড়েছে; পঠন-পাঠনে সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে, অগ্রসর চিন্তায় ভাটা পড়েছে, একটা বিরাট জনগোষ্ঠী ইসলাম থেকে একেবারেই দূরে সরে গেছে। তারা অজ্ঞতাজনিত কারণে ইসলাম সম্পর্কে যাচ্ছে তাই বলে যাচ্ছে। ইসলাম ও এর মহান সৌন্দর্য জনসম্মুখে সুন্দরভাবে উপস্থাপনের দক্ষ লোকের অভাব দেখা দিয়েছে। ফলস্বরূপ গোটা জাতির মধ্যে তৈরি হয়েছে মূলবোধের প্রকট অভাব ও অনৈতিকতার  দুষ্ট প্রভাব।
ইসলামের সৌন্দর্য ও কল্যাণকে উদ্ভাসিত করতে হলে জরুরী ভিতিত্তে বাস্তব শিক্ষার সমন্বয়ে ইসলামী স্কলার তৈরির জন্যে ইসলামী শিক্ষার পাঠ্যক্রম ঢেলে সাজানো, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শরীয়া অনুষদ খোলা এবং শরীয়া অনুষদের অন্তর্ভুক্ত করে আধুনিক বিশ্বের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ইসলামী শিক্ষার সংস্কার করা সময়ের অপরিহার্য দাবি। নয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠ এ মুসলিম জনপদ থেকে উগ্রবাদ, নাস্তিক্যবাদসহ ইসলাম সম্পর্কে সামাজিক অস্থিরতা দূর করা সম্ভব হবে না।
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না, অনৈতিকতার সয়লাবে গা ভাসিয়ে পাশ্চাত্যে হাহাকার শুরু হয়েছে। পাশ্চাত্যের সমাজবিজ্ঞানীরা সভ্যতা বিনষ্টের আশংকা করছেন। ভোগবাদিতার গ্রাস থেকে ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষার জন্যে প্রতিদিন দলে দলে উচ্চশিক্ষিত মানুষ ইসলামের আদর্শে দীক্ষা নিয়ে আল্লাহ ও রাসূল স.-এর পরকালমুখী জীবনবিধান অনুশীলন করছে। অথচ আমরা প্রগতির মরীচিকায় ধ্বংসের চোরাবালিতে জাতিকে ঠেলে দিচ্ছি। ফলে জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে অজ্ঞ নৈতিকতাহীন প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে। জীবনের গতি প্রকৃতি সম্পর্কে যাদের স্পষ্ট কোন ধারণা নেই। এমন প্রজন্ম যে কোন জাতি ও সমাজের জন্যে অত্যন্ত শংকা ও দুর্ভাগ্যের বিষয়।
আমাদের দেশের নব্বই শতাংশ মানুষ মুসলিম। হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া আল্লাহ ও রাসূলকে অস্বীকার করে এমন মানুষের সন্ধান পাওয়া কঠিন। এহেন অবস্থায় এখানে ইসলামী আইন সম্পর্কে শিক্ষা ও গবেষণা উপেক্ষিত হবে, তা একেবারেই বেমানান এবং কুরআন ও সুন্নাহর ওপর বিশ্বাসের পরিপন্থী।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, আমাদের দেশের পাঠ্যক্রম অনুসরণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানের মুসলিম স্কলার তৈরির সুযোগ কম। এক্ষেত্রে রয়েছে বিশাল শূন্যতা। আমাদের  অনেকের মধ্যে এ শূন্যতার ধারণাটুকুও অনুপস্থিত। একটি মাত্র গ্রন্থে শূন্যতা পূরণের হঠকারী দাবি আমরা করবো না, তবে শূন্যতা সম্পর্কে ধারণা দেয়ার ক্ষুদ্র চেষ্টা হিসেবেই “বিশ্বখ্যাত মনীষীদের রচনায় ইসলামী আইন” শীর্ষক এই প্রকাশনা।
এই সংকলনে ইবনে খালদুন, শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী, আবদুল কাদের আওদা, প্রফেসর আবু যাহরা, ড. মুস্তফা আহমদ যারকা, মাওলানা সাইয়্যেদ আবু হুমায়রা, সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদবী, ড. মুহাম্মদ হামীদুল্লাহ, মারুফ আদ-দাওয়ালিবীসহ মোট ৩৪ জনের ৪০টি রচনা ছাপা হয়েছে। চতুর্দশ শতাব্দীর ইবনে খালদুন থেকে একবিংশ শতাব্দির প্রফেসর খুরশীদ আহমদ পর্যন্ত বিশ্বের খ্যাতিমান মনীষীদের রচনার সমাহার ঘটানো হয়েছে। এর মধ্যে বহুল আলোচিত বৃটিশ প্রধান বিচারপতি আলফ্রেড ডেনিং, জর্জ হোয়াইটক্রস প্যাটন, ইটালির আইনবিদ ড. সি  নালিনিও এর রচনাও রয়েছে।
আটটি অধ্যায়ের এ সংকলন দুটি খণ্ডে বিভক্ত। প্রথমে ইসলামী আইনের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। পরবর্তীতে ইসলামী আইনের প্রয়োজনীয়তা, কার্যকারিতা, আইন রচনার ভিত্তি ও উৎস, কৌশল ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। শেষের দিকে রয়েছে বিশ্বখ্যাত কয়েকজন মুসলিম মনীষীর অভিমত। সর্বশেষ সংযুক্ত করা হয়েছে বিভিন্ন ভাষায় রচিত ইসলামী আইনের রচনাবলির একটি তালিকা; যাতে ইসলামী আইনের তথ্যভাণ্ডার সম্পর্কে কিঞ্চিত ধারণা পাওয়া যাবে।
সর্বশেষ একটি কথা না বললেই নয়, এ গ্রন্থে সন্নিবেশিত প্রায় সবগুলো রচনা অনেক পুরনো। দু চারটি রচনায় কালের ছাপও রয়ে গেছে, কিন্তু সময়ের ধারাবাহিকতায় আজও যে তাঁদের চিন্তাগুলো একান্তই প্রাসঙ্গিক, জীবন্ত ও অনুসরণীয়, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। মোদ্দা কথা হলো, কুরআন ও সুন্নাহকে যারা পুরনো বলে উপেক্ষা করেন আমরা তাদের সাথে ভিন্নমত পোষণ করি। কুরআন ও সুন্নাহর নিরিখে রচিত এ মনীষীদের রচনাগুলো যে কোন উৎসাহী পাঠক ও গবেষকের জন্যে প্রাসঙ্গিক বিবেচিত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
সবগুলো রচনাই বিভিন্ন ভাষা থেকে অনূদিত। প্রত্যেক লেখকের বিস্তারিত পরিচিতি দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু কয়েকজনের পরিচিতি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ইন্টারনেট-এ যাদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে কেবল তাদের পরিচিতি প্রথম খণ্ডের শেষে যুক্ত করা হয়েছে। যাদের পরিচিতি পাওয়া যায়নি কিন্তু রচনা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, তাদের বিস্তারিত পরিচয় না পেলেও তাদের রচনা গ্রন্থিত করা হয়েছে।
সবদিক বিচারে এ কাজটি বাংলাভাষার ইসলামী তথ্যভা-ারে ইসলাম সম্পর্কে কতোটুকু তথ্য সংযোজন করতে সক্ষম হবে, তা বিচারের ভার বিজ্ঞজনদের বিবেচনার ওপর রইলো। এ গ্রন্থের ভালোর সবটুকু আল্লাহর অনুগ্রহ এবং ত্রুটি ও বিচ্যুতিগুলো সবই আমাদের অজ্ঞতা ও সীমাবদ্ধতা। গ্রন্থটি যদি বাংলা ভাষার ইসলামী তথ্যভা-ারে সাদরে গৃহীত হয় এবং ইসলাম সম্পর্কে সামান্যও ধারণা বৃদ্ধি করে, তাহলে আমাদের এ শ্রম সার্থক হবে। মহান  আল্লাহ আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা কবুল করুন এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে উত্তম বিনিময় দান করুন।

নিবেদক
শহীদুল ইসলাম
সদস্য সচিব
সম্পাদনা পরিষদ

ডেপুটি এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর
বাংলাদেশ ইসলামিক ল’ রিসার্চ এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার

তথ্য সংগ্রহে: আলমগীর হোসাইন
ল’ রিসার্চ সেন্টার