আইন সহায়তা বিভাগ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত হওয়া সত্ত্বেও দেশটি ঔপনিবেশিক আমলের পুরনো বৃটিশ আইন-কানুনের ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে। বিগত দু'শ পঞ্চাশ বছর থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামী আইনের অনুপস্থিতির ফলে মুসলিম মানস ও জীবন ধারায় অনেক অনাকাঙ্খিত পরিবর্তন এসেছে। দীর্ঘকাল ইসলামী আইনের যথাযথ চর্চা না থাকায় এর প্রয়োগ ক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। ইসলামী আইন সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপপ্রয়াস পূর্বের যে কোন সময়ের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ইসলামী আইনের শ্রেষ্ঠত্ব ও সর্বজনীন কল্যাণ সম্পর্কে মুসলমানদের অজ্ঞতাও বেড়ে গেছে। তাই প্রচলিত ও ইসলামী আইনে পারদর্শী লোকদের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে ইসলামী আইনের উপযোগিতা ও প্রায়োগিক ক্ষমতা উপস্থাপন করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। "একমাত্র ইসলামী আইন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সকল নাগরিকের মধ্যে সমতার ভিত্তিতে ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম" এটা কেবল মুসলমানদের বিশ্বাসই নয়, এব্যাপারে রয়েছে মুসলিম শাসনের গৌরবোজ্জ্বল অতীত। অতীতের আলোকে বর্তমান ও ভবিষ্যত মুসলমানদের পথনির্দেশের প্রেক্ষাপটেই প্রতিষ্ঠিত হয় 'বাংলাদেশ ইসলামিক ল' রিসার্চ এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার'। যা আজ সময়ের অপরিহার্য দাবী।
সামাজিক অস্থিরতা ও ক্রমবর্ধমান অপরাধ প্রবণতা
প্রযুক্তির উন্নয়ন ও সহজলভ্যতার সুযোগে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত এ দেশের অপরাধ জগতেও যোগ হয়েছে অভিনব মাত্রা। অপরাধ বৃদ্ধির প্রধান কারণ নৈতিক মূল্যবোধের ঘাটতি ও অনৈতিকতার চাষবাস। ক্রমবর্ধমান মাদকাসক্তি, চোরাকারবারী, কালোবাজারী, চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক চৌর্যবৃত্তি, দস্যুতা জবরদখল রাষ্ট্রীয় ও একটি বিশেষ শ্রেণীর লুণ্ঠনের মাধ্যমে সমাজে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বেড়েই চলছে। সেই সাথে ধর্মহীনতা ও বস্তুবাদের কুফল হিসাবে নারী, শিশু ও অসহায় নাগরিক নির্যাতনের ভয়ংকর রূপ প্রতিভাত হচ্ছে।
জটিল বিচার প্রক্রিয়া ও নিরীহদের ভোগান্তি
বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা, মামলা-জট, নিরীহদের ভোগান্তি বিচার প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতার কারণে জনমনে বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে নানা ধরনের সংশয় বিরাজ করছে। জেলখানায় কয়েদী ও হাজতীদের সংখ্যা দুই যুগেরও বেশিকাল ধরে ধারণ ক্ষমতার বাইরে। মুসলিম অধ্যুষিত এ দেশে ইত্যাকার যাবতীয় সমস্যা নিরসনে ইসলামী বিচার ব্যবস্থাই দিতে পারে বাস্তবোচিত, ক্রটিমুক্ত ও যুগোপযোগী সমাধান।
আইন সহায়তার ক্ষেত্রে সরকার-এর দৃষ্টিভঙ্গি
সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা-১৯৪৮ এ মানুষের আইনের মাধ্যমে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে "আইনের সম্মুখে সমতার অধিকার" নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। সাংবিধানিক নিশ্চয়তা সত্ত্বেও দরিদ্র ও অসহায় ব্যক্তিগণ মাঝে মধ্যেই আইনি জটিলতা ও পদ্ধতিগত ক্রটির কারণে বৈষম্যমূলক আচরণ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। এমতাবস্থায় অসহায় মামলাগ্রস্তদের আইনী সহায়তা দিতে কতিপয় স্বেচ্ছাসেবী ও দাতব্য সংস্থার উদ্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এ ধরনের সংস্থাগুলোকে নানাভাবে অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা দিচ্ছে। ইসলামী আদর্শকে সমুন্নত রেখে, অসহায় মানুষকে আইনী সহযোগিতা দিতে ১৯৯৫ সালে জন্ম লাভ করে 'বাংলাদেশ ইসলামিক ল' রিসার্চ এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার'। সংস্থার আইন সহায়তা বিভাগ প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে অসহায় দরিদ্র মজলুমের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যথাযথ আইনী সহায়তা প্রদানের চেষ্টা করে আসছে।
আইন সহায়তা : ইসলামের নির্দেশনা
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ স. ঘোষণা করেছেন- "তোমার ভাইকে সাহায্য কর, জালেম হোক বা মজলুম হোক, অর্থাৎ জালেমকে জুলুম করা হতে নিবৃত কর এবং মজলুমকে জুলুম থেকে মুক্তিলাভে সাহায্য কর"। জুল্ম বহুমাত্রিক ও সর্বব্যাপী। সর্বাবস্থায় মজলুম নিরুপায়, অসহায় ফলে সাহায্যের মুখাপেক্ষী। পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে যে কেউ অন্যায়ভাবে জুল্মের শিকার হোক সে সাহায্যের উপযোগী। কুরআন এবং সুন্নাহ সক্ষম ও সামর্থবানদের বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে মীমাংসা করে দিতে তাগীদ দিয়েছে। সেই সাথে সীমালঙ্ঘন না করা উত্তম সুপারিশ করা, সৎ পরামর্শ দেয়া, দ্বন্দ্ব দূর করা, কল্যাণকর যে কোন কাজে পারস্পরিক সহমর্মিতা প্রকাশ ও সহযোগীতা করার নির্দেশ দিয়েছে।
আইন সহায়তা বিভাগের লক্ষ
সমাজের সর্বস্তরে সুবিচার নিশ্চিত করার লক্ষে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন এবং নির্যাতিত অসহায়দের আইন সহায়তা দান।
নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের আইন সহায়তা বিভাগ সাহায্য করে
* আর্থিক অসচ্ছল, সহায়-সম্বলহীন এবং নানাবিধ আর্থ-সামাজিক কারণে আইন আদালতের দ্বারস্ত হতে অসমর্থ বিচার প্রার্থীদেরকে।
* অসহায় মজলুমদের আইনী সহায়তা।
* নির্যাতিতা নারী ও শিশুদের আইনী সহায়তা।
* মিথ্যা মামলায় জড়িতদেরকে।
* যৌতুক সংক্রান্ত মামলায় নির্যাতিত পক্ষকে।
* জেলখানায় বিনা অপরাধে অথবা মিথ্যা সাজানো মামলায় আটক ব্যক্তিদের মুক্তিলাভে।
* আইনগত কারণে বিপন্ন ও বিগথগামী নারীদের আইনী সহায়তা প্রদানের পর নৈতিক মান উন্নয়ন ও পুনর্বাসনকল্পে।
* পাচার, অপহরণ ও প্রতারণায় শিকার অসহায় নারী ও শিশুদের পুনর্বাসন কল্পে।
* বিনা বিচারে আটক, কারাভোগের পর বিপর্যস্তদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত সহায়তা প্রদান।
* অসহায় আশ্রয়হীন বিপদগামী, অনাথ পথশিশুদের নৈতিক ও কর্মমুখী শিক্ষাদানের মাধ্যমে কর্মযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা।