আলহামদুলিল্লাহ! মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে ইসলামী আইন ও বিচার জার্নালের বহুল প্রত্যাশিত ইসলামী ব্যাংকিং বিশেষ সংখ্যা (৭৪ ও ৭৫) তম সংখ্যা প্রকাশিত হলো। বিভিন্ন ধাপে যাচাই বাছাইয়ের কয়েকটি স্তর পেরিয়ে এবারের সংখ্যায় ইসলামী ব্যাংকিং এর বিভিন্ন বিষয়ের উপর মোট দশটি প্রবন্ধ চূড়ান্ত হয়েছে।
শুরুতেই স্থান পেয়েছে “ক্যাশ ওয়াক্ফকারীর লভ্যাংশ ভোগ ও মূল টাকা উত্তোলন: একটি ফিকহী বিশ্লেষণ” শীর্ষক প্রবন্ধে ক্যাশ ওয়াক্ফকারীর লভ্যাংশ ভোগ ও মূল টাকা উত্তোলন সম্পর্কে একটি ফিকহী বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রবন্ধটিতে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে তা হলো, ওয়াক্ফ করার পর ওয়াকফকারী নিজেই যদি অনাকাঙ্খিত দুরবস্থার শিকার হন, তখন প্রয়োজন পূরণের জন্য ক্যাশ ওয়াকফের মূল টাকার সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ হস্তগত করতে পারবেন কি না। ‘তুলনামূলক ফিকহী’ পদ্ধতিতে রচিত এ প্রবন্ধটিতে প্রবন্ধকার প্রসিদ্ধ চার মাযহাবের বরেণ্য আলেমদের গ্রন্থসমূহ থেকে ফিকহী মতামত উপস্থাপন করে নিজস্ব যুক্তিপ্রমাণসহ জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করার প্রয়াস পেয়েছেন।
বিশ্বের দরবারে কোনো দেশের মর্যাদা সমুন্নত করার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সামাজিক অবকাঠামোর উন্নতি ও টেকসই অর্থনীতি। বাংলাদেশে রাজস্ব ঘাটতি, বিদেশী বিনিয়োগের স্বল্পতা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে কাঙ্খিত মানের টেকসই অর্থনীতি ও সামাজিক অবকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। “টেকসই উন্নয়ন অর্থায়নে সুকূকের ব্যবহার : পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ” প্রবন্ধে ইসলামী বিনিয়োগ সনদ ‘সুকূক’কে কিভাবে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়নের পাশাপাশি টেকসই উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও প্রবন্ধটিতে সুকূকের বৈশিষ্ট্য, সুকূকের মাধ্যমে বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্পসমূহে অর্থায়নের সম্ভাবনা, সুকূক এর বাজার সম্প্রসারণে চ্যালেঞ্জ ও করণীয়সমূহ সম্পর্কে সারগর্ভ আলোচনা উপস্থাপন করা হয়েছে।
ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থায় কল্যাণমুখী কার্যক্রমে ক্যাশ ওয়াক্ফের অবদান সংক্রান্ত প্রবন্ধটি। বস্তুত মানবকল্যাণ ও ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়নের মহান উদ্দেশ্য নিয়েই আধুনিক যুগে ইসলামী ব্যাংকিং শুরু হয়েছিল। চড়াই উৎরায় পেরিয়ে সফলতার সোপানে পা রেখে অনেক অমুসলিম দেশেও ইসলামী ব্যাংকিং ছড়িয়ে পড়েছে। কল্যাণমুখী এই ব্যাংক ব্যবস্থার মূলে রয়েছে ইসলামী শরীআহ। শরীআহর অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে গণমানুষের দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ। এরই ধারাবাহিকতায় শরীআহ প্রণয়ন করেছে ওয়াক্ফের বিধান। আবহমানকাল থেকে চলে আসা জনকল্যাণের এই খাতটি উপনিবেশ শাসনামলে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হলেও স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ধীরগতিতে চালু হয়েছে। সাম্প্রতিক কালে বিভিন্ন ইসলামী ব্যাংক নগদ অর্থ ওয়াক্ফ করার সুযোগ রেখেছে। ব্যাংকিং পরিভাষায় এর নাম ‘ক্যাশ ওয়াক্ফ’। ওয়াক্ফকারী ক্যাশ ওয়াক্ফের মাধ্যমে যে কোনো দীনি কল্যাণ ও সেবামূলক খাতে অবদান রাখতে পারেন। প্রবন্ধের মাধ্যমে পাঠক জানতে পারবেন, কল্যাণমুখী সমাজ বিনির্মাণে ক্যাশ ওয়াক্ফের ভূমিকা ও পদ্ধতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইসলামী অর্থনীতিতে ক্রয়-বিক্রয়ভিত্তিক এক ধরনের সরবরাহ চুক্তিকে ‘ইসতিজরার’ বলা হয়। “বাংলাদেশে ইসলামিক ব্যাংকিং এ ইসতিজরার বিনিয়োগ: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ” প্রবন্ধটিতে ইসতিজরার এর শরয়ী বিধান সম্পর্কে চার মাযহাবের বিজ্ঞ ফকীহদের মতামত তোলে ধরা হয়েছে। এছাড়াও ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থায় ইসতিজরার চুক্তির প্রয়োগ, বিশেষত ইসতিজরারের প্রায়োগিক দিক সম্পর্কে ইসলামী ব্যাংক কর্মকর্তাগণ কী ধরনের চিন্তাভাবনা রাখেন তা সাক্ষাতকারের মাধ্যমে প্রবন্ধকার উপস্থাপন করার প্রয়াস পেয়েছেন। সবশেষে বাংলাদেশে ইসতিজরার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ ও এর সমাধান পেশ করে উক্ত প্রবন্ধের উপসংহার টানা হয়েছে।
‘কালচার’ বা সংস্কৃতি কোনো সমাজ বা গোষ্ঠীর পরিচয় বহন করে। “ইসলামী ব্যাংকসমূহের কর্পোরেট কালচার: পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ” প্রবন্ধে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকসমূহের আধুনিক কর্পোরেট কালচারের বিভিন্ন স্তরকে নানা আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। শরী‘আহভিত্তিক পরিচালিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইসলামী মূল্যবোধ, নীতি-আদর্শ ধারণে অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছে। প্রবন্ধটিতে লেখক আধুনিক কর্পোরেট কালচারের সাথে ইসলামী ব্যাংকসমূহের কর্পোরেট কালচারের বিভিন্ন উপাদান, তত্ত্বের সাথে বাস্তবতার ফারাক ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। ইসলামী ব্যাংকগুলোতে ইসলামের আদর্শ ও মূল্যবোধভিত্তিক কর্পোরেট কালচারকে আরো উন্নত কিভাবে করা যায় সে সম্পর্কিত প্রস্তাবনা উত্থাপন করে প্রবন্ধের ইতি টানা হয়েছে।
যাকাত ইসলামের পাঁচটি মূলস্তম্ভের অন্যতম একটি স্তম্ভ। আল কুরআনে আল্লাহ তাআলা সালাতের সাথেই যাকাতের কথা উল্লেখ করেছেন। ইসলামের ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সমন্বিত রূপ হলো যাকাত। “ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের যাকাত মূল্যায়ন ও হিসাবায়ন পদ্ধতি” শীর্ষক প্রবন্ধে আইনানুগ ব্যক্তি হিসেবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সম্পদের ওপর যাকাত প্রদান করতে হবে কিনা, করলে তার নির্ধারণ প্রক্রিয়া ও হিসাবায়ন পদ্ধতি কী হবে-এ নিয়ে শরী‘আহভিত্তিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রবন্ধে পূর্ববর্তী ফকীহগণের মতামত উল্লেখপূর্বক আধুনিক বিভিন্ন ফিকহ একাডেমীর সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করা হয়েছে। বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতিতে রচিত এ প্রবন্ধ পাঠান্তে পাঠক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সম্পদের ওপর যাকাত ধার্য হবে কিনা এ ব্যাপারে মুজতাহিদ ফকীহগণের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবহিত হবেন এবং উক্ত যাকাত মূল্যায়ন প্রক্রিয়া ও হিসাবায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাবেন।
প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিকল্প হিসাবে এবং শরীয়াভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ইসলামী ব্যাংকের পথচলা শুরু হয়েছিল। সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য শুরুর দিকে কিছু বিষয়ে নমনীয়তা প্রদর্শন করা হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলো সঞ্চয় নীতি ও মুনাফা বণ্টন পদ্ধতি। “ইসলামী ব্যাংকিং-এ সঞ্চয় নীতি ও মুনাফা বণ্টন পদ্ধতি : সমস্যা ও উত্তরণ উপায়” শীর্ষক প্রবন্ধে প্রচলিত সঞ্চয় পদ্ধতি পর্যালোচনার মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিং এর জন্য স্বতন্ত্র কিছু সঞ্চয় নীতি ও মুনাফা বণ্টন পদ্ধতির রূপরেখা প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রবন্ধটিতে ট্রেডিং হাউজ মডেল, করজ ভিত্তিক সেভিং হাউজ মডেল ও ওয়াকফ হাউজ মডেল সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। ইসলামী ব্যাংকিংব্যবস্থাকে আরও শরী‘আহর অনুগামী করতে প্রবন্ধটি চিন্তার খোরাক জোগাবে।
“বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ে ব্যাসেল-৩ নীতিমালা পরিপালন: একটি পর্যালোচনা” শীর্ষক প্রবন্ধে আর্থিক মন্দা মোকাবেলা, টেকসই ব্যাংকিং কাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যাসেল কমিটির গৃহীত পদক্ষেপ, ইসলামী ব্যাংকের কর্মপদ্ধতি ও ব্যাসেল অ্যাকর্ডগুলোর কার্যাবলী মূল্যায়ন করা হয়েছে। প্রবন্ধে তিনটি ঝুঁকির বিষয়ে ব্যাসেল নীতিমালায় আলোচনা করা হয়েছে। সেগুলো হলো: ক্রেডিট ঝুঁকি, অপারেশনাল ঝুঁকি ও মার্কেট ঝুঁকি। এছাড়াও ব্যাসেল গঠনের প্রেক্ষাপট, ‘ব্যাসেল ১,২,৩’ এর গুরুত্ব, সুবিধা-অসুবিধা, মানদ- এবং ইসলামী ব্যাংকগুলোতে ‘ব্যাসেল ৩’ কতটুকু পরিপালন হচ্ছে- ইত্যাদি বিষয়সমূহ প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে।
টেকনোলজি বাদ দিয়ে আধুনিক বিশ্বকে কল্পনা করা সম্ভব নয়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই পৌঁছে গেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। বর্তমান অর্থনীতিতে টেকনোলজির অবদান অনস্বীকার্য। ফাইন্যান্স ও টেকনোলজি শব্দের মিথস্ক্রিয়ায় উদ্ভব হয়েছে ফিনটেক শব্দ। টেকনোলজিভিত্তিক পণ্য ও সেবা প্রদানকারী ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস কোম্পানির ক্ষেত্রে এ পরিভাষাটি ব্যবহৃত হয়। “ইসলামিক ফিনটেক: ধারণা এবং প্রয়োগ” শীর্ষক প্রবন্ধে ফিনটেক এবং ইসলামিক ফিনটেকের মূল ধারণা এবং ভবিষ্যতের কর্মপরিকল্পনা সৃষ্টি সম্পর্কে সবিস্তারে আলোচনা করা হয়েছে। প্রবন্ধটিতে ফিনটেকের কিছু উদ্ভাবন যেমন ব্লকচেইন, ক্রাউডফান্ডিং, ক্রিপ্টোকারেন্সি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। পাশাপাশি ইসলামের দৃষ্টিতে এগুলো ব্যবহারের নীতিমালা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রবন্ধের শেষে বাংলাদেশে শরীয়াহ্ সম্মত ফিনটেকের ব্যবহারের দিকনির্দেশনা উপস্থাপন করা হয়েছে।
“ইসলামী অর্থব্যবস্থা মানবকল্যাণ ও টেকসই উন্নয়নের অনন্য পদ্ধতি: একটি পর্যালোচনা” প্রবন্ধটিতে মানবকল্যাণ ও টেকসই উন্নয়নে ইসলামী অর্থব্যবস্থার বহুমুখী নির্দেশনাসমূহ সবিস্তারে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও লেখক প্রবন্ধটিতে ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূলনীতি, টেকসই উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা, ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীর আলোকে টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়নের রোডম্যাপ- ইত্যাদির গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনার প্রয়াস পেয়েছেন।
ইসলামী আইন ও বিচার জার্নালের ইসলামী ব্যাংকিং বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী। প্রবন্ধগুলো থেকে পাঠকগণ উপকৃত হবেন এবং বরাবরের ন্যায় এবারের সংখ্যাটিও সকলের কাছে সমাদৃত হবে বলে আমরা আশা রাখি।
মহান আল্লাহ আমাদের এ প্রচেষ্টাকে কবুল করুন। - প্রধান সম্পাদক