بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيمِ
ইসলামের ব্যবসায় ও বাণিজ্য আইন-৫ম খণ্ড
সম্পাদনা পরিষদ কর্তৃক সম্পাদিত
প্রথম প্রকাশ : এপ্রিল-২০২৩
প্রকাশকের কথা
‘আল-মাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ’ কুয়েত সরকারের ওয়াক্ফ ও ইসলাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত পঁয়তাল্লিশ খ-ের ‘ইসলামী ফিকহ বিশ্বকোষ’। এই বিশ্বকোষে আরবী আদ্যাক্ষর অনুযায়ী ইসলামী আইনের প্রতিটি পরিভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সারা বিশ্বে এটি ফিক্হের ওপর একটি সর্বজনগ্রাহ্য বৃহৎ কাজ। ‘বাংলাদেশ ইসলামিক ল’ রিসার্চ এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার’ এই বিশ্বকোষটি পর্যায়ক্রমে বাংলা ভাষায় প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। এ কাজের প্রথম পদক্ষেপ ছিল ‘ইসলামের পারিবারিক আইন’ প্রথম ও দ্বিতীয় খ-। এর দ্বিতীয় পদক্ষেপ” ইসলামের ব্যবসায় ও বাণিজ্য আইন। ইতোমধ্যে “ইসলামের ব্যবসায় ও বাণিজ্য আইন” সম্পর্কে ৪টি খ- প্রকাশিত হয়েছে। এটি এই সিরিজের ৫ম খ-, যেটিতে ২৮টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আমরা আশা করি, এ গ্রন্থটিও পূর্ববর্তী গ্রন্থগুলোর ন্যায় বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মাদরাসার ছাত্র, শিক্ষক, ইসলামী আইনের গবেষক, ব্যবসায়ী, ব্যাংক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ও কর্মকর্তাবৃন্দ এবং আইন পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের ইসলামের ব্যবসায় ও বাণিজ্য আইন জানা ও গবেষণায় সহায়ক ভূমিকা রাখবে। বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংকিং এবং ব্যবসায়ে জড়িত ব্যক্তিবর্গ, আইনের চর্চা ও আইন পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ ইসলামের ব্যবসায় ও বাণিজ্য বিষয়ক ইসলামী আইনের দালিলিক প্রমাণ ও প্রধান মাযহাবগুলোর বিশুদ্ধ ভাষ্য সম্পর্কে অবহিত হতে পারবেন। ফলে বাংলাভাষী সাধারণ মানুষ বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংকিং, শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা এবং আইনচর্চা ও পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের অনেকের মধ্যে ইসলামী আইন সম্পর্কে যেসব ভুল ধারণা রয়েছে তা দূরীভূত হবে; সেই সাথে শিক্ষকম-লী ও দাওয়াত-কর্মীদের জ্ঞান আরো সমৃদ্ধ হবে। ফলে সমাজে ইসলামী শরীআহর চর্চা সহজতর হবে। বিশ্বব্যাপী ইসলামের নবজাগরণকে সামনে রেখে দেশবাসীকে ইসলামী আইন সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এ গ্রন্থের প্রকাশ। পূর্বে প্রকাশিত খ-গুলোর মতো এ খ-টিও সুধী মহলে আদৃত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ইসলামের সঠিক বিধান জানা এবং তা পালন করার তাওফীক দিন। আমীন।
বাংলাদেশ ইসলামিক ল’ রিসার্চ এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার-এর পক্ষে
শহীদুল ইসলাম
নির্বাহী পরিচালক
মুখবন্ধ
‘আইনের শাসন’ আজ বিশ্বব্যাপী পরম কাক্সিক্ষত। সুবিচার বর্তমানে মানবজাতির প্রধান কাম্য বিষয়। আইনের শাসন-এর অর্থ আইন থাকবে সবার ঊর্ধ্বে। আইন চলবে তার নিজস্ব গতিতে। আইনের চোখে ছোট বড় সবাই থাকবে সমান। ক্ষমতা, আভিজাত্য, অর্থ বা অন্য কিছুর প্রভাব আইনের গতি রোধ করবে না। সুবিচার-এর অর্থ হলো, দুর্বলতম ব্যক্তির অধিকার পাইয়ে দেয়ার দায় কাঁধে নেয়া এবং সবলের অন্যায় প্রতিহত করা। জুলুম ও অপরাধ দমন করা, সাধারণ নাগরিকের সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য কেবল বিচারব্যবস্থাই যথেষ্ট নয়। শুধু আইন, আইনের শাসন নিশ্চিত করে না। আইন ও বিচার থাকলেও অনেক সময় দেখা যায় সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা, সুনীতি ও সদ্ভাবের বিকাশ হয় না। এ ক্ষেত্রে আইন ও বিচারব্যবস্থা একটি জরুরি ব্যবস্থাপত্র মাত্র। মূল কাজটি হচ্ছে, সকল নাগরিকের মাঝে আইন মানার মানসিকতা তৈরি করা।
ন্যায়পরায়ণতা, দেশপ্রেম, শান্তিপ্রিয়তা, মানবিক চেতনা ও বিবেচনাবোধ ইত্যাদি মানুষকে সৎ থাকতে সাহায্য করে। এ ক্ষেত্রে বড় সহায়ক হচ্ছে ধর্মীয় বিশ্বাস। এ বিশ্বাসই মানুষকে খোদাভীতির মাধ্যমে নিজকে নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা দিয়ে থাকে এবং আখেরাতে জবাবদিহিতার চিন্তা একজন মানুষের মধ্যে মজবুত দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করে। এ ছাড়াও আরো অনেক প্রেরণাদায়ী বিষয়ও মানুষের বিবেচনার ক্ষেত্রে নৈতিকতার শক্ত ভিত গড়ে দিতে পারে। তখনই কেবল এ মানুষটি থেকে অন্য মানুষ নিরাপদ থাকতে পারে। বিচার ও শাসনকার্যেও ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখার জন্য নৈতিকতার প্রেরণা অপরিহার্য। ‘বাংলাদেশ ইসলামিক ল’ রিসার্চ এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার’ গণমানুষের মধ্যে এই নৈতিক প্রেরণা জাগ্রত করার জন্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
ইসলামী আইনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি নৈতিকতা ভিত্তিক আইন (খধি ইধংবফ ড়হ গড়ৎধষ ঠধষঁবং)। গণমানুষের মধ্যে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ জাগ্রত হলে তারা আইন মানার জন্যে প্রস্তুত থাকে। ফলে আইনের প্রয়োগ সহজ হয়। স্বপ্রবৃত্ত হয়ে মানুষ আইন পালন করে এবং অন্যকেও আইন মানতে উজ্জীবিত করে। আইনভঙ্গের প্রবণতা নি¤œতম মাত্রায় চলে আসে।
ইদানিং বাংলাদেশে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত অপরাধের ক্ষেত্রে নতুন নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ নৈতিক অবক্ষয় ও এর বিস্তার। নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে নারী ও শিশু নির্যাতনের ভয়ংকর রূপ প্রতিভাত হচ্ছে। অপরাধ বৃদ্ধির কারণে বাড়ছে মামলা, বাড়ছে বিচারপ্রার্থীর সংখ্যা। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং প্রতিদিন নতুন নতুন মামলা সৃষ্টি হওয়ার কারণে মামলার জট ক্রমশ বেড়েই চলেছে। অপরদিকে বিচার সম্পর্কে লোকজনের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে নানা ধরনের সংশয় ও হতাশা। জেলখানায় কয়েদী ও হাজতীদের সংখ্যা বর্তমানে ধারণ ক্ষমতার বাইরে। সেখানে তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত। উপরিউক্ত যাবতীয় সমস্যা নিরসনকল্পে আমরা মনে করি, ইসলামী বিচারব্যবস্থা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহর কিতাব এবং রাসূলুল্লাহ #-এর সুন্নাহ-এর আলোকে শাসক, বিচারক, আইনজীবী, বাদী, বিবাদী ও সাক্ষীসহ সর্বস্তরের নাগরিকদের মানসিক ও নৈতিকবৃত্তিকে উজ্জীবিত ও শক্তিশালী করার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে উপরিউক্ত পাহাড়সম সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।
আল্লাহর বিধান সকল মুসলিমের জন্য অবশ্য পালনীয়। ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠি নির্বিশেষে সকল মানুষের অধিকার রক্ষা করা সকল মুসলিমের কর্তব্য। ইসলামী আইন ও বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে দেশের জনগণকে অবহিত করা এবং ইসলামী আইন ও বিচারের আলোকে জনগণের ন্যায় ও সুবিচার পাওয়ার অধিকার সহজতর করার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯৫ সালে ‘বাংলাদেশ ইসলামিক ল’ রিসার্চ এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সংস্থার কর্মসূচির অন্যতম অংশ হচ্ছে, ইসলামী আইন ও বিচারব্যবস্থার উপযোগিতা ও সামষ্টিক কল্যাণ নিয়ে গবেষণা ও প্রকাশনা। সংস্থা ‘ইসলামী আইন ও বিচার’ নামে একটি ত্রৈমাসিক গবেষণা পত্রিকা প্রকাশ করে আসছে। সেই সাথে তুলনামূলক আইনবিষয়ক পুস্তক প্রকাশের কাজও করছে। ইতোমধ্যে এ সংস্থা ইসলামী আইন সংক্রান্ত ৩৫টি পুস্তক প্রকাশ করেছে।
৪৫ খ-ের ‘আল-মাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ’ একটি বিশাল কর্ম। এটিই সম্ভবত বিশ্বের সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ ফিকহী প্রকাশনা। আমরা ইতোপূর্বে এই বিশাল সাগর থেকে “ইসলামের পারিবারিক আইন” শীর্ষক ২টি খ- প্রকাশ করেছি। এগুলো বোদ্ধা মহলে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে। আল-মাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ-প্রকল্পের দ্বিতীয় পদক্ষেপ “ইসলামের ব্যবসায় ও বাণিজ্য আইন” ১ম, ২য়, ৩য় ও ৪র্থ খ- ইতোমধ্যে ব্যাংকিং ও একাডেমিক সেক্টরে ব্যাপকভাবে আদৃত হয়েছে। এই সিরিজের ৫ম খ-ের কাজ সমাপ্ত করতে পারায় আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করছি। এটিতে ২৮টি ভুক্তি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাভাষায় দালিলিক প্রমাণসহ ইসলামী আইন বিষয়ক প্রকাশনা অপ্রতুল। যেগুলো আছে সেগুলোর অধিকাংশই ফিক্হের পাঠ্য গ্রন্থাদির অনুবাদ। সেগুলো সাধারণ পাঠকের জন্য সহজবোধ্যও নয়। এ পুস্তকটিতে অন্তর্ভুক্ত ব্যবসায় ও বাণিজ্য সম্পর্কিত প্রত্যেকটি বিষয়ের ইংরেজি প্রতিশব্দ এবং প্রসিদ্ধ মাযহাবগুলোর বক্তব্য দলিল-প্রমাণসহ উপস্থাপন করা হয়েছে। ফলে সম্মানিত পাঠকগণ এখানে সব মাযহাবের ভাষ্য একসাথে পাবেন।
ইসলামী শিক্ষা ও জ্ঞানের জগতে ‘আল-মাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ’ যেমন অনন্য অর্জন, এর বাংলা ভাষ্য ‘ইসলামী ফিক্হ বিশ্বকোষ’ও বাংলা সাহিত্যে এক অপূর্ব সংযোজন। আমাদের জ্ঞানসাধনার জগৎ এ ধরনের অনবদ্য অবদানে ঋদ্ধ হোক। আলোক অন্বেষী শিক্ষিত প্রজন্ম খুঁজে পাক সাফল্যের ঠিকানা। ইসলামের কল্যাণময় জীবনব্যবস্থার দিক-দর্শন আধুনিক সমাজে প্রচারের কাজে নিয়োজিত ‘বাংলাদেশ ইসলামিক ল’ রিসার্চ এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার’ তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের পথে সাফল্যের শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করুক- গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকাশনার শুভ মুহূর্তে মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে এই আমাদের প্রার্থনা।
উল্লেখ্য যে, আল-মাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাতে কেবল প্রাচীন ফিকহবিদদের মতামত বিবৃত হয়েছে। বিশেষভাবে আধুনিককালের যারা ফিকহের ক্ষেত্রে কাজ করেছেন যেমন মুহাম্মদ আল-গাযালী, ড. ইউসুফ আল-কারযাভী, ড. ওহাবাহ আয-যুহাইলী, ড. আবু যাহরা, আব্দুল্লাহ বিন বায, মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-উসাইমীন, বিচারপতি তাকী উসমানী, মুজাহিদুল ইসলাম কাসেমী, হাসান তুরাবী প্রমুখের ফিকহী মতামত তাদের গ্রন্থসমূহে পাওয়া যাবে।
সম্পাদনা পরিষদের পক্ষে
শহীদুল ইসলাম
সদস্য সচিব
আল-মাওসূআতুল ফিক্হিয়্যাহ অনুবাদ ও সম্পাদনা প্রকল্প
এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর
বাংলাদেশ ইসলামিক ল’ রিসার্চ এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার