ইসলামী আইন ও বিচার Islami Ain O Bichar
Vol 18 No 69 & 70 (2022)
Published: Sep 19, 2022
সম্পাদকীয়
আলহামদুলিল্লাহ! মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে ইসলামী আইন ও বিচার জার্নালের ৬৯ ও ৭০তম সংখ্যা প্রকাশিত হলো।
মানুষ মাত্রই চিন্তা চেতনায়, কাজে-কর্মে একে অন্যের থেকে ভিন্ন। মানবজাতির স্বভাবজাত এ প্রকৃতির কারণে চিন্তাচেতনার ভিন্নতা মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গণ্য। ইসলামের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে প্রতীয়মাণ হয়, আল্লাহর রাসূল সা.-এর সময়কাল থেকেই মুসলিম সমাজে চিন্তার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তবে সেসময় এর ব্যাপ্তি ছিলো অনেক কম। তাঁর সময় কোনো বিষয়ে মতানৈক্য দেখা দিলেই আল্লাহর পক্ষ থেকে তার সমাধান জানিয়ে দেয়া হতো। পরবর্তীতে এ জাতীয় মতপার্থক্য নিরসনের ক্ষেত্রে উম্মাহর আলিমগণকে ভূমিকা রাখতে হয়েছে। যুগে যুগে স্থান-কালপাত্র ভেদে এমন কিছু একনিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের আগমন ঘটেছে; যারা এ সমস্যার সমাধানে সর্বব্যাপী প্রচেষ্টায় রত ছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় আধুনিক কালে যেসব মুসলিম ব্যক্তি পশ্চিমা ঔপনিবেশিক ও সা¤্রাজ্যবাদের বিপর্যয় থেকে মুসলিমদের পুনর্জাগরণ ও নিজেদের মধ্যকার চিন্তানৈতিক মতপার্থক্য নিরসনে বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন, তুরস্কের ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক বদিউজ্জামান সাঈদ নূরসী (১৮৭৭-১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি ছিলেন ধর্মীয় ও আধুনিক জ্ঞানের আলোয় আলোকিত একজন মানুষ। তিনি মুসলিম উম্মাহর চিন্তানৈতিক মতবিরোধকে অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেন এবং তা নিরসনে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। তিনি কপটতা পরিহার করে সহনশীলতা ও আল-কুরআনের পদ্ধতি অনুসরণে সংলাপের মাধ্যমে মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার আহ্বান করেন। ব্যাপকার্থে তিনি বর্তমান মুসলিম উম্মাহর মতবিরোধ ও বিভক্তি নিরসনে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস; সহনশীলতা; প্রমাণসহ চিন্তা ও যুক্তি উপস্থাপন; জ্ঞান, ধর্ম ও নৈতিকতার মাঝে সমম্বয় সাধন; সীমালঙ্ঘন পরিহার করে মধ্যপন্থা অবলম্বন এবং বিশুদ্ধ আকিদা (বিশ্বাস)-এর ভিত্তিতে সুদৃঢ় মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার রূপরেখা প্রদান করেন। উক্ত রূপরেখাকে বিশ্লেষণ করে প্রণীত হয়েছে “মুসলিম উম্মাহর চিন্তানৈতিক মতবিরোধ নিরসনে বদিউজ্জামান সাঈদ নূরসীর দৃষ্টিভঙ্গি : একটি পর্যালোচনা” শীর্ষক প্রবন্ধটি।
মানব সভ্যতার শুরু থেকে মানুষ নানা পেশায় নিয়োজিত ছিল। ব্যবসা তন্মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক পেশা। সম্ভ্রান্ত বংশের লোকজনসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ ব্যবসায়ের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আমাদের প্রিয় নবী সা. নবুওয়াতের পূর্বে ব্যবসায়ের কাজে নিয়োজিত ছিলেন; বিভিন্ন দেশে ব্যবসায়িক কাফেলার সাথে ভ্রমণ করেছেন। সাহাবায়ে কেরামের রা. মধ্যে অনেকেই ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীনের রহ. মধ্যে অনেকেই ব্যবসায়ের সাথে জড়িত ছিলেন। ব্যবসায়ের মাধ্যমে হালাল জীবিকার্জনের পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্ব পালনেরও সুবর্ণ সুযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বেশি লাভের আশায় হালাল পন্থা অবলম্বন না করে ভেজাল মিশিয়ে ব্যবসায় প্রতারণা করছে। ব্যবসায়ের মত পবিত্র পেশাকে নানা রকম ভেজালের মাধ্যমে কলুষিত করা হচ্ছে। অহরহ ঠকানো হচ্ছে সাধারণ ক্রেতাকে, প্রতারণার শিকার হচ্ছেন আম জনতা। ব্যবসায় ভেজালের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নানা অভিনব কৌশল অবলম্বন করে পণ্যে ভেজাল মিশিয়ে প্রতারণার নব দুয়ার উন্মোচিত হচ্ছে। সমাজের সর্বত্র ভেজালে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। উৎপাদিত খাদ্যপণ্যে ভেজাল মিশিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা মানুষের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করছে। কালের পরিক্রমায় সৎ, সত্যবাদী, বিশ্বস্ত ও নিষ্ঠাবান ব্যবসায়ী খুঁজে পাওয়া বড় দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে। “উৎপাদিত খাদ্যপণ্যে ভেজাল প্রতিরোধে রাসূলুল্লাহ সা.-এর নির্দেশনা” শীর্ষক প্রবন্ধে উৎপাদিত খাদ্যপণ্যে ভেজাল প্রতিরোধে প্রচলিত আইন ও রাসূলুল্লাহ সা.-এর নির্দেশনা তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
সমাজে বসবাসরত দরিদ্র, অসহায়, নিঃস্ব-সম্বলহীন মানুষের আর্থিক অবস্থা পরিবর্তনের অন্যতম মাধ্যম মাইক্রো ফাইন্যান্স। অর্থসংস্থানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মাইক্রো ফাইন্যান্স আজ উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশে বেশ জনপ্রিয়। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশেই আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এটি বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। দারিদ্র্য নির্মূলে মাইক্রো ফাইন্যান্সের সাফল্য বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এর প্রভাব সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষেরা তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠাচ্ছে, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করছে, বসবাসের অবকাঠামো উন্নত করছে, চিকিৎসাসেবা নিচ্ছে। ইসলামী মাইক্রো ফাইন্যান্স এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে। কারণ সেখানে সুদ ও ঘারার মুক্ত মাইক্রো ফাইন্যান্স কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। উৎপাদন, বিপণনসহ সকল ক্ষেত্রে অসহায়-দরিদ্রদের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন নিশ্চিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও মাইক্রো ফাইন্যান্সের কার্যক্রম লক্ষণীয়। বিগত তিন দশক ধরে বাংলাদেশে সাধারণ মাইক্রো ফাইন্যান্সের পাশাপাশি ইসলামী মাইক্রো ফাইন্যান্স কার্যক্রম ও ব্যাপকভাবে প্রসারিত হচ্ছে। “ইসলামী মাইক্রো ফাইন্যান্স: বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে একটি পর্যালোচনা” শীর্ষক প্রবন্ধে এ বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরা হয়েছে।
বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার মধ্যে আত্মহত্যা একটি জঘন্য অপরাধ। যা শুধু একটি প্রাণই কেড়ে নেয় না বরং তা সমাজের প্রতিটি মানুষের প্রাণে আঘাত করে, মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী ও তরুণ যুব-সমাজ যারা রাষ্ট্রের ভবিষ্যত চালিকা শক্তি তাদের মাঝে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে আত্মহত্যা। আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পথে অশনি সংকেত। এ সমস্যার সমাধানে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ, আইন প্রণয়ন ও নীতিমালা প্রয়োগ করা হলেও তা সফল হচ্ছে না, বিধায় “বাংলাদেশে আত্মহত্যার কারণ ও এর প্রতিকারে প্রচলিত আইন ও ইসলামী বিধান: একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা” শীর্ষক এ প্রবন্ধটি রচিত হয়েছে।
অন্য আরেকটি সমাজিক সমস্যা হলো, মিথ্যা। পৃথিবীতে সংঘটিত অপরাধসমূহের মূলে রয়েছে মিথ্যা। মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনে খুব ছোটো ছোটো বিষয়েও মিথ্যা বলে থাকে। সাধারণত কারো সাথে কৃত অঙ্গীকার রক্ষা করা, কোনো ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয়া, কোনো গোপন বিষয়ের আমানত রক্ষার বিষয়ে মিথ্যা সংঘটিত হলে বহুজন ক্ষতিগ্রস্থ হয় সেই সাথে ইসলামের দৃষ্টিতে এটি মারাত্মক গুনাহ। বর্তমানে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে যেভাবে মিথ্যার প্রসার ঘটছে তা অতি শীঘ্রই রুদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। আর এ জন্য ধর্মীয় অনুশাসনের কোনো বিকল্প নেই। এতে করে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রীয় জীবন ধ্বংস হওয়া থেকে রেহাই পাবে। “মিথ্যার স্বরূপ ও বিধান: প্রচলিত ও ইসলামী আইনের আলোকে একটি পর্যালোচনা” শীর্ষক প্রবন্ধে ইসলামী শরীয়াহ এবং প্রচলিত আইনের বিভিন্ন ধারার ভিত্তিতে আমাদের বর্তমান সমাজের বেশ কিছু চিত্রের সাথে মিলিয়ে মানবজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মিথ্যা বলার পরিণাম, শাস্তি ও বিধান, মিথ্যাচার প্রতিরোধ ও প্রতিকারে ধর্মীয় অনুশাসন পরিপালন এবং সমাজ ও রাষ্ট্রে মিথ্যা পরিহার করার জন্য ধর্মীয় অনুসরণ অন্যতম কার্যকর উপায় সম্পর্কে আলোচনা উপস্থাপন করা হয়েছে।
সর্বশেষে ১ম সংখ্যা থেকে ৭০তম সংখ্যা পর্যন্ত প্রকাশিত সকল প্রবন্ধের একটি সংখ্যাভিত্তিক তালিকা সংযোজন করা হয়েছে। আশা করি এতে উৎসাহী পাঠক ও গবেষকগণ উপকৃত হবেন।
এ সংখ্যায় প্রকাশিত সবগুলো প্রবন্ধ থেকে সংশ্লিষ্ট সকলেই উপকৃত হবেন এবং অন্যান্য সংখ্যার মতো এ সংখ্যাও সাদরে গ্রহণ করবেন বলে আমরা আশা রাখি। মহান আল্লাহ আমাদের এ প্রচেষ্টাকে কবুল করুন।
- প্রধান সম্পাদক