ইসলামী ব্যাংকিং ও বাণিজ্যিক পরিভাষা/মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহ খন্দকার

Spread the love

ইসলামী ব্যাংকিং বিশ্বব্যাপী আজ এক সমুজ্জ্বল বাস্তবতার নাম। সুদভিত্তিক ব্যাংকব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে ইসলামী ব্যাংকিং ইতোমধ্যে শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। শুধু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেই নয় বরং লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, প্যারিস, ফ্রাঙ্কফুর্ট, সিঙ্গাপুর, টোকিও ও টরেন্টোর মতো প্রচলিত ব্যাংকব্যবস্থার কেন্দ্রগুলোতেও ইসলামী অর্থায়ন মডেলের উপস্থিতি বেগবান হচ্ছে। বর্তমানে ১২৫টি দেশে প্রায় ছয় শতাধিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ইসলামী ব্যাংকিং চালু রয়েছে।

বিশ্বের বহু দেশেই এখন ইসলামী অর্থায়ন পদ্ধতি গুরুত্বের সাথে আলোচিত হচ্ছে। নামি-দামি বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন, ডারহাম, হার্ভার্ড ও স্ট্যানফোর্ডের মতো বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের ৭৫টি দেশের নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং বিষয়ে পাঠ দান করা হচ্ছে।

বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা তিন দশক অতিক্রম করেছে এবং সাফল্যের সাথে ধর্ম-বর্ণ, দল-মত নির্বিশেষে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। আইডিবি ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মডেল হিসেবে বাংলাদেশকে বিবেচনা করে। নাইজেরিয়া, উগান্ডা ও শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ এখন অবদান রাখছে। মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য ও উপসাগরীয় দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোতে শারী’আহ্ পরিপালনের অবস্থা ভালো। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এতসব অর্জন ধরে রাখার জন্য ব্যাপক গবেষণা ও অধ্যয়নের বিকল্প নেই।

‘পরিভাষা হলো বিশেষ অর্থ প্রকাশকারী শব্দ বা শব্দরাশি। যে শব্দদ্বারা সংক্ষেপে কোনো বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে ব্যক্ত করা যায় তাই পরিভাষা; বা অনেক অর্থবিশিষ্ট শব্দও যদি প্রসঙ্গ-বিশেষে নির্দিষ্ট অর্থে প্রযুক্ত হয়, তবে তাও পরিভাষারূপে গণ্য হয়। সাধারণত পরিভাষা বললে এমন শব্দ বা শব্দাবলিকে বোঝায় যার অর্থ পণ্ডিতগণের সম্মতিতে স্থিরীকৃত হয় এবং যা দর্শন-বিজ্ঞানাদির আলোচনায় প্রয়োগ করলে অর্থবোধে সংশয় ঘটে না।’

বিগত তিন দশকে বাংলা ভাষায় ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং বিষয়ে প্রকাশনার দিগন্ত প্রসারিত হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। এ ছাড়া বিভিন্ন ভাষায় ইসলামী ব্যাংকিং পরিভাষার ওপর স্বতন্ত্র গ্রন্থ থাকলেও বাংলা ভাষায় তা অনুপস্থিত। কিন্তু এ প্রয়োজন অনস্বীকার্য।

বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকের পরিধি দ্রুতগতিতে বাড়ছে কিন্তু সে তুলনায় জানবার মাধ্যম খুবই কম। আরবিভাষী পাঠকদের কাছে বিষয়টি তেমন কঠিন না-ও হতে পারে। কেননা, মাতৃভাষার মাধ্যমেই তারা ইসলামী ব্যাংকিং ও বাণিজ্যিক পরিভাষা অধ্যয়নের সুযোগ পেয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাভাষী পাঠকরা এ সুযোগ থেকে অনেকটা বঞ্চিত। আজকাল বাংলা ভাষায় ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ক অনেক বই পাওয়া যায়। সেগুলাতে নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকার পরও ইসলামী ব্যাংকিং জানার ক্ষেত্রে সেগুলোর অবদান খাটো করে দেখার নয়।

বাংলা ভাষায় ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ক যেসব বই প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো আরবি পরিভাষাকে বাংলায় প্রতিবর্ণায়নের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ আরবি রীতিনীতির পরিবর্তে অনেকটা উর্দু কিংবা বাংলা রীতি অনুসরণ করা হয়। যেমন আরবি ‘আকদুল মুরাবাহা’কে বাংলায় প্রতিবর্ণায়ন করা হয়েছে ‘আকদে মুরাবাহা’ আবার শারী’আহ পরিভাষার প্রতিবর্ণায়ন করা হয়েছে ‘শরিয়া’। আবার কেউ কেউ ইংরেজি রীতি অনুসরণ করে ইসলামী পরিভাষার উচ্চারণ করেছেন। যেমন, ‘মাকাসিদুশ শারী’আহ্’-কে ইংরেজি রীতি অনুসরণ করে লিখেছেন ‘মাকাসিদ আল-শরিয়াহ’। কিন্তু বাংলা ভাষার অন্তর্নিহিত একটি শক্তি রয়েছে, যা অন্যভাষাকে অবিকল প্রতিবর্ণায়ন করা যায়।

তাই বংলা বর্ণমালায় আরবি শব্দাবলির যথাসম্ভব শুদ্ধ ও মূলের নিকটবর্তী উচ্চারণের ব্যাপারে কারো উদাসীন থাকা উচিত নয়। এ ব্যাপারে সকলের সচেতনতা আবশ্যক।

কাজেই ইসলামী ব্যাংকিংও বাণিজ্যিক শব্দমালার বিশুদ্ধ আরবি উচ্চারণের একটি প্রাঞ্জল পরিভাষার প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘদিন ধরে অনুভূত হয়ে আসছে। এ চাহিদা পূরণ যেমন কষ্টসাধ্য, প্রচেষ্টা সে তুলনায় আরো কম। আল্লাহ তা’আলার অশেষ রহমতে আমার মতো একজন সাধারণ মানুষ এ জটিল ও কাষ্টসাধ্য কাজে হাত দিয়েছে। নানা সীমাবদ্ধতা থাকার পরও গ্রন্থটি পাঠে সাধারণ পাঠক যেমন উপকৃত হবেন, তেমনি এ বিষয়ে যারা অভিজ্ঞ বলে সমাজে পরিচিত, তাঁরাও এ কাজ দেখে ইসলামী ব্যাংকিং পরিভাষাকে সমৃদ্ধকরণে অনুরূপ প্রচেষ্টায় উদ্যোগী হতে অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।

এই বইয়ে ইসলামী ব্যাংকিং ও বাণিজ্যিক পরিভাষাগুলোকে প্রথমে বিষয়ভিত্তিক উল্লেখ করা হয়েছে। আর যেসব পরিভাষা সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করা যায় না, সেগুলোকে বাংলা বর্ণানুক্রমে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিটি পরিভাষা উল্লেখ করার ক্ষেত্রে প্রথমে পরিভাষাটির বাংলা উচ্চারণ, পরে বন্ধনীর ভেতরে মূল আরবি পরিভাষা অতঃপর বাংলায় প্রয়োগিক অর্থ এবং তার ইংরেজি অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে।

কোনো কোনো দেশে ইসলামী ব্যাংকিং ও বাণিজ্যিক পরিভাষাগুলো সরাসরি আরবি শব্দে না লিখে ইংরেজি ভাষায় লেখা হয়েছে। কিন্তু এ গ্রন্থে তাকে আরবি, ইংরেজি ও বাংলায় উল্লেখ করা হয়েছে। এ গ্রন্থের শেষে বাংলা বর্ণানুক্রম অনুসরণপূর্বক একটি নির্ঘণ্ট সংযোজন করা হয়েছে। এতে বাংলাভাষীদের জন্য পরিভাষার পাঠ সহজ হতে পারে।

এ বইতে পরিভাষাগুলো খুব সহজ ভাষায় তুলে ধরার প্রয়াস রয়েছ। শুধু শাব্দিক অর্থ ও সংজ্ঞার মধ্যই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি বরং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নাহ্র দলিল-প্রমাণ, পরিভাষার প্রয়োগ ক্ষেত্র এবং কোথাও কোথাও এর হুকুম নিয়েও কিঞ্চিত আলোচনার প্রয়াস রয়েছ।

ইসলামী ব্যাংকিং ও বাণিজ্যিক পরিভাষাগুলোর সাথে কুরআন-সুন্নাহ, ইসলামী শারী’আহ, মাকাসিদুশ শারী’আহ, ইসলামী অর্থনীতি ইত্যাদির সম্পর্ক গভীর ও নিবিড়। তাই প্রাসঙ্গিক কারণে এসব পরিভাষা থেকে এমন কিছ পরিভাষা এ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলো ছাড়া ইসলামী ব্যাংকিং ও বাণিজ্যিক পরিভাষার পূর্ণতা আসে না।

আশা করি, বাংলাভাষী পাঠকসমাজে বইটি সমাদৃত হবে এবং চিন্তাশীল লেখকসম্প্রদায়ের মধ্যে সৃজনশীল প্রতিযোগিতার পথ খুলে দিতে সাহায্য করবে। বইটি পাঠ করে ইসলামী ব্যাংকের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, গ্রাহক-ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, গবেষক, আলিম, ইমাম ও ওয়ায়েজসহ সকল স্তরের সুধীজন ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কে নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ হবেন বলে আমার বিশ্বাস।

মানবিক দুর্বলতা ও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে নানাবিধ ত্রুটি-বিচ্যুতি অগোচরে থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কোনো ভুল-ত্রুটি কারো নজরে এলে আমাকে তা অবগত করা হলে কৃতজ্ঞ হবো। বইটির ব্যাপারে সকলের সুচিন্তিত অভিমত সাদরে গৃহীত হবে।

বিস্তারিত জানতে দেখুন-ইসলামী ব্যাংকিংও বাণিজ্যিক পরিভাষা- সূচিপত্র

Scroll to Top