ইসলামী আইনের উৎস/ড.মুহাম্মদ রুহুল আমিন

Spread the love

ইসলামী জীবনব্যবস্থার সর্বজনীনতা, পূর্ণতা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের একটি মৌলিক দিক হলো ইসলামী আইন ও ইসলামী বিচারব্যবস্থা। আইন ও বিচারব্যবস্থার সাথে ইসলামের আকীদা বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগী তথা সার্বিক কর্মকাণ্ডের সম্মিলন ঘটার কারণে ইসলামী আইন বহুমাত্রিক গুরুত্ব বহন করে। ইসলামী আইন অন্যান্য আইন থেকে যেসব কারণে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী তার অন্যতম দিক হলো, ইসলামী আইনের রয়েছে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা (Principles)। আইন প্রণয়নের জন্য ইসলামী আইনে একটি স্বতন্ত্র নীতিশাস্ত্র রয়েছে। এ শাস্ত্রকে উসূলুল ফিক্‌ (The Principles of Islamic Jurisprudence) বলা হয়।

হিজরী ৩য় / খ্রিস্টীয় ৯ম শতাব্দীতে এ উসূলে ফিকহের উৎপত্তি হয়েছে মনে করা হলেও অনুসন্ধানে দেখা যায়, হিজরী ১ম / খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে এ বিষয়ক আলোচনা শুরু হয়। ইমাম আবু হানীফা (৬৯৯-৭৬৭ খ্রি.) ‘আল-রাঈ’ (যুক্তি-দর্শন) নামক গ্রন্থ প্রণয়ন করেন, যাতে ইসলামী আইন উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে যুক্তি-দর্শন প্রয়োগের নীতিমালা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ইমাম আবু হানীফার দুই সহচর ইমাম আবু ইউসূফ (৭৩১-৭৯৮ খ্রি.) ও ইমাম মুহাম্মদ আশ-শায়বানী (৭৪৯-৮০৪ খ্রি.) এ বিষয়ে বিশেষ অবদান রাখেন। ইমাম আবু ইউসুফ প্রধান বিচারপতি থাকাবস্থায় সর্বপ্রথম ‘উসূলুল ফিকহ’ পরিভাষাটি ব্যবহার করেন এবং ইমাম মুহাম্মদ ‘আল-ইজতিহাদ আর-রাঈ’ (যুক্তিনির্ভর ইজতিহাদ) ও ‘আল-ইসতিহসান’ (উত্তম বিধানের অগ্রাধিকার/Doctrine of Juristic Preference) বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, ইমাম শাফিঈ (৭৬৭-৮২১ খ্রি.) তাঁর ‘আর-রিসালাহ’ (বার্তা) গ্রন্থটি প্রণয়নের মাধ্যমে এ শাস্ত্রকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক নতুন শাখা হিসেবে উপস্থাপন করেন।

ইসলামী আইনের মৌলিক উৎস (Material Source) কুরআন ও সুন্নাহ। কিন্তু যেসব বিষয়ের বিধান সরাসরি কুরআন অথবা সুন্নাহে নেই সেসব বিষয়ের ‘আহকাম’ বা বিধি প্রণয়নই (Formulate of Ruling) উসূলুল ফিকহের উদ্দেশ্য। কুরআন ও সুন্নাহ’র পাশাপাশি ইসলামী আইন উৎসারিত হওয়ার আরও কিছু সম্পূরক উৎস (Complementary / Subordinate Sources) রয়েছে। ইসলামী আইনের মৌলিক ও সম্পূরক এ দু’ধরনের উৎসের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে জনাব মুহাম্মদ রুহুল আমিন ‘ইসলামী আইনের উৎস’ শীর্ষক এ গ্রন্থ রচনা করেছেন।

মুহাম্মদ রুহুল আমিন পেশায় একজন শিক্ষক হলেও তাঁর মূল পরিচয় তরুণ শিকড়সন্ধানী গবেষক ও প্রাবন্ধিক হিসেবে। ইসলামী আইনের বিভিন্ন বিষয়ে পূর্বসূরি আলিমগণের মতামতকে সম্বল করে এর আধুনিক প্রয়োগের দিক-নির্দেশনা প্রদানই তাঁর লেখার মূল বৈশিষ্ট্য। আশা করি, তার প্রণীত ‘ইসলামী আইনের উৎস’ গ্রন্থটিও পাঠকমহলে সমাদৃত হবে।

জনাব আমিন তাঁর গ্রন্থের শুরুতে আইন (Law), কানুন (Act), ফিক্‌ (Islamic Jurisprudence), শরীআহ (Law of Islam) ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ইসলামী আইনের বৈশিষ্ট্য ও অন্যান্য আইনের সাথে এর তুলনা করে প্রমাণ করেছেন যে, ইসলামী আইন সর্বজনীন এবং সর্বকালের সব মানুষের জন্য কল্যাণের নিশ্চয়তা দেয়।

ইসলামী আইনের যেসব উৎসের ব্যাপারে সকলের মতৈক্য রয়েছে যেমন কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াসের বর্ণনার ক্ষেত্রে এগুলোর আইনী মর্যাদা (Legal Position), কুরআনের আইন বর্ণনা পদ্ধতি, কুরআন থেকে আইন উদ্ভাবনের নীতিমালা, আইন বর্ণনার ক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নাহ’র পারস্পরিক সম্পর্ক, ইজমা ও কিয়াসের প্রামাণিকতা (Authenticity), বর্তমান সময়ে ইজমা’র সম্ভাব্যতা, কিয়াসের মাধ্যমে বিধান নির্ণয়ের মূলনীতি ইত্যাদি বিষয় এ গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে। অন্যদিকে সম্পূরক উৎসসমূহ বর্ণনার ক্ষেত্রে লেখক বিভিন্ন মাযহাবের (Juristic Schools) দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখপূর্বক এর প্রামাণিকতা বর্ণনা করেছেন এবং এগুলোর ভিত্তিতে বিধান উদ্ভাবনের শর্ত ও বর্তমান সময়ে তার প্রয়োগের নীতিমালা তুলে ধরেছেন।

গ্রন্থটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এতে ইসলামী আইন সম্পর্কে আমাদের সমাজে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা চিহ্নিত করে তথ্য-প্রমাণ ও যুক্তির আলোকে তা খণ্ডন করা হয়েছে। এছাড়াও সমকালীন বিষয়সমূহের ইসলামী বিধান নির্ণয়ের জন্য পূর্বসূরি মুসলিম মুজতাহিদগণ নির্দেশিত এসব উৎসের পাশাপাশি অন্য কী কী পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে, সে সম্পর্কিত আলোচনাটি বর্তমান ও ভবিষ্যতের ইসলামী আইন গবেষকদের পাথেয় হিসেবে কাজ করবে। আমি মনে করি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সভ্যতার উৎকর্ষ, জীবনাচরণের পরিবর্তন কোনো কিছুই ইসলামী আইনের সর্বজনীনতা ও উপযোগিতাকে যে ব্যর্থ ও অকার্যকর প্রমাণ করতে পারবে না, গ্রন্থকার তা অত্যন্ত সফলতার সাথে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন।

“বাংলাদেশ ইসলামিক ল’ রিসার্চ এন্ড লিগাল এইড সেন্টার” প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের জন্য সুধী মহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। এর নানামুখী কর্মকাণ্ডের মধ্যে ইসলামী আইন বিষয়ক গবেষণামূলক প্রকাশনা অন্যতম। আমার মনে হয় এরই ধারাবাহিকতায় ‘ইসলামী আইনের উৎস’ গ্রন্থটি কর্তৃপক্ষ প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। আমি এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তথ্যবহুল এ গ্রন্থটি ইসলামী আইনের শিক্ষার্থী ও ইসলামী আইন বিষয়ে গভীর অধ্যয়ন ও গবেষণায় আগ্রহীদের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করবে। এ কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য লেখক আমাদের সকলের আন্তরিক মোবারকবাদ ও বিশেষ দু’আ পাওয়ার যোগ্য। আমি এ গ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করি। সেই সাথে প্রতিষ্ঠানের সমৃদ্ধি ও সাফল্যের জন্য আল্লাহ তা’আলার নিকট দু’আ করি।

বিস্তারিত জানতে দেখুন-ইসলামী আইনের উৎস-সূচিপত্র

Scroll to Top