আলহামদুলিল্লাহ, আসসালাতু ওয়াসসালামু আ’লা রাসূলিল্লাহ।
পবিত্র রমযান মাস বাংলাদেশে একটা ভিন্ন আবহ তৈরি করে। মসজিদগুলোতে নামাযীর সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনি আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটেও একটা ভিন্ন পরিবেশ বিরাজ করে। রমযান অর্থনীতিতে যাকাতের বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব পায়। যদিও যাকাতের লেনদেন বছরের যে কোন সময় হতে পারে কিন্তু অঘোষিতভাবে রমযান মাসেই দাতা ও গ্রহীতাগণের মধ্যে সিংহভাগ লেনদেন হয়ে থাকে। দেশের হাজার হাজার কওমী মাদরাসা ও মক্তবের ব্যয় নির্বাহের বড় অংশ যাকাত থেকেই সংগৃহীত হয়ে থাকে। এছাড়া বহু এতীমখানা বৃদ্ধাশ্রম, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানও যাকাত নির্ভর কর্মকাণ্ড পরিচালনায় যাকাত সংগ্রহ করে।
দু’শত বছর আগেও যাকাতের উৎস তথা দাতাদের শ্রেণিচরিত্রে তেমন বৈচিত্র ছিল না। কারণ বিত্ত-বৈভবের অধিকারী হওয়ার পথ-প্রক্রিয়া ছিল প্রায় নির্দিষ্ট ও সীমিত। কিন্তু বর্তমানে হালাল উপায়েও বিত্তবান হওয়ার হাজারো পথ উন্মুক্ত এবং আয় উপার্জন, ব্যবসা বাণিজ্যের ধরনে এতোটাই বৈচিত্র এসেছে যে, এগুলোর প্রকারভেদ নির্ণয়ও যথেষ্ট শ্রমসাধ্য। বলা চলে, শিল্প বিপ্লবের পর ব্যবসা বাণিজ্য ও আয়-উপার্জনের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া বহুমুখী হওয়ার কারণে যাকাতের আধুনিক ক্ষেত্রগুলো বিস্তৃত ও ব্যাপক হয়েছে। সেই সাথে এগুলোর হিসাব নিকাশেও রয়েছে পদ্ধতিগত ভিন্নতা, যা পূর্বেকার যাকাতদাতাদের ব্যবসা বাণিজ্য ও উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাচে ফেলে মূল্যায়ন করলে সঠিক হবে না।
অপর দিকে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আট শ্রেণির যাকাতগ্রহীতার মধ্যেও কোন কোন খাত এখন আর পূর্বের অবস্থায় নেই, যেমন দাসমুক্তি। এছাড়া অন্যান্য খাতগুলোর ব্যাপ্তি ও পরিধির ব্যাপারেও যথেষ্ট চিন্তা গবেষণার অবকাশ আছে। কিন্তু সমস্যা হলো এসব বিষয় একান্তই শরীয়া বিশেষজ্ঞদের কাজ। সেই সাথে আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও আধুনিক সমাজ ও অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা ছাড়া এসব বিষয়ে একজন আলেম কিংবা সাধারণ অর্থনীতিবিদের পক্ষে কোন সিদ্ধান্ত ও উপসংহারে পৌঁছানো দুরূহ ব্যাপার। কেননা যুগের উৎকর্ষ ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণে যাকাত সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাকাত বিষয়ে নানামুখি অধ্যয়ন ও গবেষণা পরিচালিত হয়। কোন কোন দেশে একাডেমিক অধ্যয়নের জন্য যাকাত ইনিস্টিটিউটও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে সার্টিফিকেট কোর্স, ডিপ্লোমা, মাস্টার্স ইত্যাদি ডিগ্রি চালু হয়েছে। পাশাপাশি এমফিল, পিএইচডিসহ উচ্চতর গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে।
অন্যদিকে যাকাত সংগ্রহ এবং সংগৃহীত অর্থের যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও সুচিন্তিত বণ্টনের মাধ্যমে যাতে বেশি করে মানুষের উপকার নিশ্চিত করা যায় এ লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দেশে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে যাকাত ব্যবস্থাপনার জন্য স্বতন্ত্র কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে। তন্মধ্যে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত “সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্ট” উল্লেখযোগ্য। ইতোমধ্যে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বহু মুসলিম দেশে এ প্রতিষ্ঠানের কর্মতৎপরতা অনুসরণীয় হয়ে ওঠেছে।
যাকাত ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত বাংলাদেশী একটি প্রতিষ্ঠানের পদ্ধতিগত এ সাফল্য সকলের জন্য সুখকর হলেও এদেশে যাকাত নিয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণার চিত্র একেবারেই ভিন্ন। এদেশে মানবকল্যাণের এ গুরুত্বপূর্ণ উৎস নিয়ে বিশেষ কোন অধ্যয়ন ও গবেষণা দৃষ্টিগোচর হয় না।
এ শূণ্যতা দূর করার প্রয়াস এবং আধুনিক প্রেক্ষাপটে যাকাতের বিধান বিষয়ক গ্রন্থের অভাব পূরণের উদ্দেশ্যে যাকাত সম্পর্কিত সমসাময়িক কিছু সমস্যা চিহ্নিত করে কয়েক বছর আগে আমরা প্রশ্নাকারে বাংলাদেশের খ্যাতিমান ৩০ জন মুফতীর কাছে সমাধানের জন্য পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু ফোনে কয়েকজনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ছাড়া লিখিত কোন জবাব পাইনি। ফলে এ সম্পর্কে গ্রন্থ রচনার উদ্যমে ভাটা পড়ে। কিন্তু বিষয়টি এমন, আমরা নির্বিকার থাকলেও এই ঘাটতির অনুভূতিটা প্রতি বছর রমযানের আগমনে আরো প্রকট হয়। চাহিদা ও আমাদের অনুরোধে সেই ঘাটতি পূরণে এগিয়ে আসেন ড. মুহাম্মদ রুহুল আমিন রব্বানী ও মুফতি মহিউদ্দীন কাসেমী। উভয়েই অপেক্ষাকৃত তরুণ ও মেধাবী। সৃষ্টিশীল রচনায় উভয়েই ইতোমধ্যে বোদ্ধামহলে অভিনন্দিত হয়েছেন। “আধুনিক প্রেক্ষাপটে যাকাতের বিধান” পাণ্ডুলিপি রচনা করতে গিয়ে তারা যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন। এজন্য তারা মোবারকবাদ পাওয়ার অধিকারী।
“আধুনিক প্রেক্ষাপটে যাকাতের বিধান” গ্রন্থে বর্তমান অবস্থায় যাকাতের উৎসগুলো চিহ্নিত করা এবং ব্যবসায়ীগণ কিভাবে যাকাতের হিসাব করবেন তা দেখানো হয়েছে। এছাড়া প্রতিটি সেক্টরের ভিন্ন ভিন্ন যাকাত বিবরণী ছক আকারে দেয়া হয়েছে। যুগ ও চাহিদার প্রেক্ষিতে গবেষণা ও দাওয়াত কার্যক্রম পরিচালনায় যাকাত ব্যয়ের প্রয়োজনীয়তা আলোচিত হয়েছে।
আমরা বিনয়ের সাথে বলবো, একাজটি নিঃসন্দেহে অনেক জটিল। আমরা বিষয়গুলো অভিজ্ঞ মহলের সামনে নিয়ে আসার উদ্দেশে এ কাজে হাত দিয়েছি। এখানে ভুলত্রুটি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। অভিজ্ঞ মহল বিষয়গুলো সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ দিকনির্দেশনা ও তথ্য দিলে আমরা সশ্রদ্ধচিত্তে সেগুলোকে সংযোজনের জন্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেই সাথে আশা করি আমাদের পরিবেশিত তথ্য-উপাত্তগুলো এ সম্পর্কে সঠিক গ্রন্থ প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তাকে আরো জোরালো করবে, আর পণ্ডিত ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ শরীয়তের এই বিষয়গুলোর ব্যাপারে জাতিকে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সরবরাহে প্রয়াস পাবেন। এই পুস্তক যাকাতদাতা এবং যাকাতের উৎস ও খাতগুলো সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট মহলকে নতুন বার্তা দেবে। গ্রন্থপাঠে যাকাতদাতাগণ যাকাতদানের ব্যাপারে শরীয়তের নির্দেশ মতো আরো সচেতন ও যত্নবান হলে আমাদের এই আয়োজন সার্থক হবে।
যা কিছু সত্য ও সঠিক হয়েছে এজন্য মহান আল্লাহর শুকরিয়া এবং ভুলত্রুটির জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও শোধরানোর তৌফিক কামনা করছি।
বিস্তারিত জানতে দেখুন-আধুনিক প্রেক্ষাপটে যাকাতের বিধান–সূচিপত্র