বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব জেনারেল সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন নামে কম্প্যারেটিভ রিলিজিয়ন বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু রয়েছে। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের পারস্পরিক জানা-বোঝা এবং সম্প্রীতির মাধ্যমে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব’ নামে একটি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীকালে এটির নামকরণ করা হয় ‘বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি’ বিভাগ। কিন্তু বাংলাদেশের ধর্মীয় পণ্ডিতদের মধ্যে এ বিষয়টি এখনো ততটা গুরুত্ব পায় নি। যদিও পূর্বেকার মুসলিম মনীষীদের মধ্যে এ বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। ইসলাম কেন আল্লাহর মনোনীত একমাত্র ধর্ম এবং সকল ধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, তুলনামূলক ধর্ম সম্পর্কে চর্চা না থাকায় এ বিষয়টির গভীরতা অনুধাবন করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়ে ওঠে না।
তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই মুসলিম স্কলারদের কাছে একটি অবশ্য পাঠ্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত ছিলো। কেননা আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমের মাধ্যমে তাঁর প্রিয়নবী মুহাম্মদ-কে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সঙ্গে ইসলামের সত্যতা ও তাদের ধর্মীয় বিধি-বিধানের বিকৃতি অবহিত করে তাদের মিথ্যা দাবির অসারতা প্রমাণের জন্য বিতর্কানুষ্ঠানের নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সা. নিজেও অমুসলিমদের সঙ্গে বিতর্ক করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম থেকে নিয়ে অদ্যাবধি কুরআন-সুন্নাহর বিশুদ্ধতা, তাওহীদের সত্যতা এবং ইহুদি-খ্রিস্টান-পৌত্তলিকদের বহু-ঈশ্বরবাদিতার দাবির অসারতা প্রমাণে বিতর্কানুষ্ঠান অব্যাহত রয়েছে।
বর্তমান সময়ে গোটা বিশ্বব্যাপী আন্তঃধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে দেশে দেশে দেখা দিয়েছে ধর্মীয় সংঘাত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইহুদি-খ্রিস্টান প্রভাবিত মিডিয়াগুলো মুসলমানদের ওপর ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও চরমপন্থার দায় চাপাচ্ছে। অথচ অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিবলে ইহুদি-খ্রিস্টান, বুদ্ধিস্ট ও পৌত্তলিক শক্তি বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ উস্কে দিয়ে সমৃদ্ধ মুসলিম জনপদগুলোকে বিরান ভূমিতে পরিণত করছে। বর্তমান ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, আফগানিস্তান এর জ্বলন্ত উদাহরণ। এর ফলে একদল মুসলিমও যে বিভ্রান্তির শিকার হয়ে নানা প্ররোচনায় উগ্রপন্থী হয়ে উঠছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমতাবস্থায় মুসলমানদেরকে বিভ্রান্তি থেকে রক্ষার জন্য তুলনামূলক ধর্মের অধ্যয়ন অত্যন্ত জরুরি। কেননা তুলনামূলক ধর্মের অধ্যয়ন একজন মুসলিমকে অপর ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সহিষ্ণু করে এবং ইসলামের বস্তুনিষ্ঠতা অমুসলিমদের কাছে যৌক্তিক ও দালিলিকভাবে উপস্থাপনে সক্ষম করে তোলে। ফলে সকল ধর্মাবলম্বীদের সহাবস্থান সুসংহত হয় এবং সামাজিক সম্প্রীতি ও শান্তি বজায় থাকে।
ড. মোহাম্মদ বেলাল হোসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক। তিনি তুলনামূলক ধর্ম বিষয়ে মিসরের আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেছেন। সময়ের দাবি ও প্রয়োজনীতার প্রেক্ষিতে তিনি তাঁর অর্জিত জ্ঞান বাংলাভাষীদের সমীপে উপস্থাপনের জন্য রচনা করেছেন ‘তুলনামূলক ধর্ম’ নামের এ গ্রন্থ।
তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব এখন একটি প্রতিষ্ঠিত শাস্ত্র। কিন্তু বাংলাভাষায় এ-বিষয়ে গ্রন্থাবলি অত্যন্ত অপ্রতুল। কয়েকজন ইতোপূর্বে এ বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন বটে, তবে এ শাস্ত্র সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভের জন্য সেগুলো যথেষ্ট নয়। ড. মোহাম্মদ বেলাল হোসেন এ গ্রন্থে
তুলনামূলক ধর্মশাস্ত্রের ইতিবৃত্তসহ সামগ্রিক ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। আমাদের কাছে তাঁর এ রচনা অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধ মনে হয়েছে। তবে এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, বাংলাভাষায় তুলনামূলক ধর্মের চর্চা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এ দেশে যাদেরকে ইসলামের ধারক-বাহক মনে করা হয়, বিশেষত মাদরাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ বিষয়ে পঠন-পাঠন খুবই অনুল্লেখ্য। অথচ পূর্বেকার মুসলিম মনীষীদের কাছে ইসলাম ও জাগতিক জ্ঞানের পাশাপাশি তুলনামূলক ধর্মজ্ঞানে দক্ষতা অর্জন ছিলো একটি অগ্রাধিকারপূর্ণ বিষয়।
উপমহাদেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় মনীষী আশরাফ আলী থানভী রহ. তাঁর এক রচনায় বলেছেন, শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী রহ.-এর পরিবারে তুলনামূলক ধর্মের চর্চা ছিলো একটি আবশ্যিক বিষয়। অথচ আমাদের দেশে সর্বোচ্চ ইসলামি জ্ঞানের আধার-বিদ্যাপীঠগুলোর মধ্যেও এ বিষয়ে ধারণালাভের কোন ব্যবস্থা রাখা হয় নি, যা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। সামগ্রিকভাবে না হলেও, বিশেষভাবে কিছু লোককে এ শাস্ত্রের ব্যুৎপত্তি লাভের জন্য উদ্বুদ্ধ করা খুব জরুরি। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, পাঠ্য সিলেবাসের বাইরে কিছু না পড়ার ব্যাপারে বিপুল সংখ্যক প্রবীণ আলিমের মধ্যে রয়েছে অতিরক্ষণশীলতা যা প্রকারান্তরে একজন প্রাজ্ঞ শরীআহবিশেষজ্ঞ হওয়ার ব্যাপারে দেয়াল তৈরি করে। আপনি একজন আলেম, দাওয়াতকর্মী, চিন্তাশীল, সমাজকর্মী, শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসক, গবেষক, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, কর্মকর্তা-যেই হোন না কেন, আপনি যদি শিক্ষিত হন, অবশ্যই আপনার জানা দরকার ধর্ম কী এবং কেন, কেন বলা হয় ইসলাম শ্রেষ্ঠ ধর্ম এবং ইসলামই আল্লাহর একমাত্র মনোনীত দীন। এ বিষয়ে আপনার স্পষ্ট ধারণা না থাকলে আপনার চারপাশের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সদাচার করতে ব্যর্থ হবেন। হয়তো অতি উদারতা দেখাতে গিয়ে আপনি ইসলামের অবমাননা করবেন, নয়তো রক্ষণশীলতা প্রদর্শন করতে গিয়ে অমুসলিমদেরকে প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হবেন।
তুলনামূলক ধর্মের চর্চা বাংলাভাষায় যেমন নতুন, তেমনি বিষয়টিও জটিল। ফলে এ শাস্ত্রে অভিজ্ঞ মুসলিম-অমুসলিম স্কলারদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় কম। ইংরেজি ও আরবি ভাষার বিশাল ভাণ্ডার থেকে পাঠকদের জন্য উপযোগী করে উপস্থাপনের কাজটি যে যথেষ্ট আয়াসসাধ্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ক্ষেত্রে ভুল-ত্রুটি থাকাটাই স্বাভাবিক। এ বিষয়ে চর্চা যত বাড়বে ভুল তত হ্রাস পাবে, বিশেষজ্ঞ তৈরি হবে এবং সমৃদ্ধ হবে এ শাস্ত্রের তথ্যভাণ্ডার।
বিজ্ঞ মহলের প্রতি আমাদের বিনীত নিবেদন, তাঁরা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে এ গ্রন্থের ভুলত্রুটিগুলো ধরিয়ে দিলে পরবর্তী সংস্করণে আমাদের পক্ষে সেগুলো শুধরে নেয়া সহজ হবে।
পরিশেষে এ গ্রন্থের লেখক ড. মোহাম্মদ বেলাল হোসেনকে তাঁর শ্রমসাধ্য গবেষণার জন্য মোবারকবাদ জানাই। সেইসঙ্গে মহান আল্লাহর কাছে তাওফীক কামনা করি, তিনি যেন ইসলামের সত্যতা ও বস্তুনিষ্ঠতা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার জন্য আমাদেরকে পর্যাপ্ত জ্ঞানে সমৃদ্ধ করেন।
বিস্তারিত জানতে দেখুন-তুলনামূলক ধর্ম সূচিপত্র