ভূমিকা
‘ওরিয়েন্টালিজম’ অর্থ ‘প্রাচ্যবাদ’। এ শব্দটি সাধারণ সমাজে খুব একটা পরিচিত নয়। অথচ প্রাচ্যবাদের প্রভাব সমাজের রন্দ্রে রন্ত্রে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, কলা, আইন, প্রশাসন, রাজনীতি.. সবক্ষেত্রে দারুন প্রভাবিত আজকের মুসলমান। সচেতন কিংবা অবচেতনভাবে। অন্যান্য দেশে ‘প্রাচ্যবাদ’ ও ‘প্রাচ্যবিদ’ সম্পর্কে যে-সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে তার সিকি পরিমাণও নেই বাংলাদেশে। কারণ বাংলাভাষায় এ-বিষয়ে তথ্যের অভাব, বই-পুস্তকের অপ্রতুলতা। আমরা জানিও না, ইসলাম, পবিত্র কুরআন, মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কিত অধিকাংশ ভুল ধারণার জন্ম প্রাচ্যবাদের গর্ভে।
ওরিয়েন্টালিস্ট তথা ‘প্রাচ্যবিদ’ শব্দটির সর্বপ্রথম ব্যবহার লক্ষ করা যায় প্রাচ্যের এক চার্চ সদস্যের ক্ষেত্রে ১৬৩০ সালে। এরপর ১৬৯০ সালে স্যামুয়েল ক্লার্ক প্রাচ্যের কয়েকটি ভাষা শিখে ‘প্রাচ্যবিদ’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। শব্দটি ইংরেজি ডিকশনারিতে প্রবেশ করে ১৭৭৯ সালে। ফরাসি একাডেমির শব্দকোৰে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ১৮৩৮ সালে।
মুসলিম বিশ্বের বহুদেশ এক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। প্রাচ্যবিদদের কথিত গবেষণার অনেক গোমর ফাঁস হয়ে যায় মুসলমানদের নিকট। ফলে ‘প্রাচ্যবাদ’ ও ‘প্রাচ্যবিদ’ শব্দগুলো অনেক দেশে নেতিবাচক হিসেবে দেখা হয়। এ-সময় আমরা দেখতে পাই, পশ্চিমা প্রচার-মাধ্যম নতুন দুটি শব্দ তৈরি করে, ‘মধ্যপ্রাচ্য গবেষণা’ ও ‘মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ’। আরব ও ইসলাম নিয়ে গবেষণা হয়ে উঠল ‘মধ্যপ্রাচ্য গবেষণা’। এ-বিষয়ের পশ্চিমা পণ্ডিত, গবেষকগণ ‘প্রাচ্যবিদ’ শব্দ বাদ দিয়ে নতুন নাম পরিগ্রহ করলেন ‘মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ’। বলাবাহুল্য, নাম ও খোলস পাল্টালেও প্রাচ্যবাদের বিষয় ও লক্ষ্য কিন্তু অভিন্নই থাকল। অনেকটা নতুন মোড়কে পুরাতন পণ্য। ‘মধ্যপ্রাচ্য গবেষণা’ নতুন এই পরিভাষাটির উদ্ভব ঘটে গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে। শব্দটির জন্মদাতা যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়াসমগ্র। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংগঠনই পরিকল্পিতভাবে তৈরি করে বিভিন্ন বিষয়ের ‘মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞদের’। বর্তমান আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের চলমান অশান্তি ও অস্থিরতার পিছনে এসব কথিত ‘বিশেষজ্ঞদের’ ভূমিকা অনস্বীকার্য।
বক্ষমাণ বইয়ে ওরিয়েন্টালিজম তথা প্রাচ্যবাদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, ইসলাম সম্পর্কে প্রাচ্যবিদদের রচনা ও গবেষণার সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়েছে। ইসলামের প্রধান প্রধান বিষয়ে তাদের তথ্যনির্ভর আলোচনা এবং আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যদশার নির্মোহ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বিশেষ করে মুসলমানদের আকিদা সম্পর্কে প্রাচ্যবিদদের বিভ্রান্তিকর তথ্য, পবিত্র কুরআন নিয়ে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বড়যন্ত্র, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সিরাত প্রসঙ্গে অথচ
প্রাচ্যবিদদের রচনা, ইসলামি আইন ও ফিশাস্ত্রে প্রাচ্যবিদদের গবেষণাকর্ম, ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে প্রাচ্যবিদদের বিদ্বিষ্ট রচনার সমীক্ষা, আরবি ভাষা ও সাহিত্যে প্রাচ্যবিদদের রচনা; এক্ষেত্রে আমাদের অসহায়ত্ব এবং সবশেষে প্রাচ্যবাদ ও মিশনারি তৎপরতার কথা কিছুটা সবিস্তারে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে লেখার গুরুত্ব উপলব্ধি করি সর্বপ্রথম ১৯৯৭ সালে। চট্টগ্রামের ব্যতিক্রমধর্মী ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামেয়া দারুল মা’আরিফ আল-ইসলামিয়ায় শিক্ষক নিযুক্ত হবার অব্যবহিত পর। তখন অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ‘মুকারানাতুল আদয়ান’ তথা ‘তুলনামূলক ধর্মতত্ব’ বিষয়টিও আমার দায়িত্বে অর্পিত হয়। এ বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত ‘ইস্তিশরাক’ অর্থাৎ ‘প্রাচ্যবাদ’ সম্পর্কে ব্যাপক অধ্যয়ন, আলোচনা ও পর্যালোচনার সুযোগ হয়। পরবর্তীতে অনেক কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়েও বিষয়টি পাঠ্যভুক্ত করা হয়। অথচ তখনও বাংলাভাষায় এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো বই ছাত্র ও শিক্ষিতমহলে পরিচিত হয়নি। এ অভাবটা বিশেষভাবে অনুভব করেছি আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের উদ্যোগে আয়োজিত ‘প্রাচ্যবাদ’ শীর্ষক একটি সেমিনারে উপস্থিত হবার পর। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. শাকের আলম শওক ওই সেমিনারে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছিলেন। উক্ত সেমিনারে আগত অতিথিদের আলোচনায় উঠে আসে বাংলাভাষায় ‘প্রাচ্যবাদ’ বিষয়ক তথ্য-উপাত্তের সংকট ও অপ্রতুলতার কথা। তখনই উপলব্ধি করেছি, আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষায় এ বিষয়ে তথ্যসমৃদ্ধ একটি বই অতীব দরকার।
এ-বইটি মূলত গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ-সংকলন। প্রবন্ধগুলো আমি বিভিন্ন সময় দেশের কয়েকটি স্বনামধন্য ইসলামি সাহিত্য ও গবেষণাবিষয়ক পত্র-পত্রিকার জন্য প্রস্তুত করেছিলাম। সবগুলো প্রবন্ধই যথাসময়ে প্রকাশিত হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ, পাঠকের সমাদর ও গুরুত্ব অনুভব করেছি। কোনো কোনো প্রবন্ধ কয়েকবার রিভিউ করা হয়েছে বোদ্ধা ও গবেষকদের মাধ্যমে। এতে বইয়ের মান বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে নিশ্চয়।
বাংলাদেশের আইন ও গবেষণা জগতে সুপরিচিত প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ ইসলামিক ল’ রিসার্চ এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার’ বইটি প্রকাশের উদ্যোগ নেয়ায় সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী সম্পূর্ণ বইটি আরেক দফা রিভিউ এবং প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও পরিমার্জন করা হয়। গবেষক, শিক্ষার্থী ও সাধারণ তথা সর্বস্তরের পাঠকদের উপযোগী করে তোলার চেষ্টা করা হয়।
তারপরেও মানুষ হিসেবে ভুল-ত্রুটি এবং মুদ্রাজনিত প্রমাদ থাকতেই পারে। এ-ক্ষেত্রে সচেতন পাঠক ও গবেষকদের সুচিন্তিত পরামর্শ কামনা করছি। মহান আল্লাহ অধমের এ-ক্ষুদ্র প্রয়াস কবুল করুন। সংশ্লিষ্ট সবাইকে উত্তম প্রতিদানে ভূষিত করুন। আমিন।
মুহাম্মদ সাদিক হুসাইন রিয়াদ, সৌদিআরব
বইটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন-ওরিয়েন্টালিজম ও ইসলাম