যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ল’ স্কুলের প্রফেসর নোয়াহ ফেল্ডম্যান যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি নিউইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনের নিয়মিত কলাম লেখক। এছাড়া তিনি মার্কিন কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স নামক সংস্থার একজন সিনিয়র ফেলো। তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থাবলী হচ্ছে: Divided by God, What We Owe Iraq, After Jihad. ২০০৮ সালে প্রকাশিত তাঁর The Fall And Rise Of The Islamic State গ্রন্থটি পাঠকমহলে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। এতে তিনি সাম্প্রতিককালে মুসলিম বিশ্বে শরীয়া আইন প্রতিষ্ঠার জনপ্রিয় দাবির বিভিন্ন দিক বিস্তারিত আলোচনা করেন। পাশ্চাত্যের অনেকে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি মনে করছে। আবার সন্ত্রাসীরা তাদের কর্মকাণ্ডকে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দোহাই দিয়ে যৌক্তিক বলে চালিয়ে দিতে চায়। নোয়াহ ফেল্ডম্যান ‘শরীয়া’ বলতে আসলে কী বোঝায় এবং ইসলামী বিশ্বে তা সুশাসন ও ন্যায়বিচার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারবে কিনা-এরূপ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাবার চেষ্টা করেছেন।
নোয়াহ ফেল্ডম্যান ট্রাডিশনাল বা ঐতিহ্যিক ইসলামী রাষ্ট্রের আইন কাঠামো এবং ঐতিহ্যের আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে, সেখানে নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইনি ব্যাখ্যার মধ্যে আলেম সমাজ তথা ইসলামী পণ্ডিতরা ভারসাম্য বিধান করতেন। কিন্তু তুরস্কে অটোমান শাসনের শেষদিকে এই ভারসাম্যের অবসান সূচিত হয়; ফলে তার পথ ধরে মুসলিম দেশগুলোতে ব্যাপক বিপর্যয় দেখা দেয় এবং ভারসাম্যহীন স্বৈরতন্ত্রের উত্থান ঘটে। তিনি মনে করেন, আধুনিক যুগে ইসলামী রাষ্ট্র ও শরীয়া আইন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বে আবার ভারসাম্যপূর্ণ সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
ফেল্ডম্যানের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, মুসলিম দেশগুলোর রাজনৈতিক প্রবণতা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামী আন্দোলনের গতি সে সব দেশে তীব্রতর হচ্ছে। আজ প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে যে, ইসলামী দলগুলোর সফলতা কি বেশি সংখ্যক ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংকেত দিচ্ছে? এর মাধ্যমে কি গণতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক শরীয়াভিত্তিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে? দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন মুসলিম দেশে সরকার বিরোধী আন্দোলন জোরদার হচ্ছে এবং এতে ইসলামী দলগুলো বেশ সক্রিয় থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, তারা সাংবিধানিক সংস্কার ও গণতন্ত্রায়ণে ইসলামী আদর্শকে সামনে নিয়ে আসতে চাইবে। তারা ক্রমবর্ধমান হারে সরকারে অংশগ্রহণ করবে এবং নানা রকম সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ইসলামী আইনকে কার্যকর করতে প্রয়াসী হবে। তবে আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন ও ইরাকের মত দেশগুলোতে সাংবিধানিক পরিবর্তন সত্ত্বেও হিংসাত্মক কার্যকলাপ ও বিশৃঙ্খলা চলতে থাকবে, যাতে সরকার ঠিকমত ইসলামী নীতি অনুযায়ী কাজ করতে না পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, চরমপন্থা চলতে থাকলে ইসলামী আইন বাস্তবায়নের জন্য যে সকল প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার তা ব্যাহত হবে।
এখন পর্যন্ত কোথাও ইসলামপন্থীদের শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা গ্রহণ করতে বা ক্ষমতা গ্রহণ করতে দিলেও ক্ষমতায় থাকতে দেয়া হয়নি। তারা ক্ষমতায় গেয়ে সরকার পরিচালনায় তাদের যোগ্যতা জনগণকে দেখানোর যথেষ্ট সুযোগ পায়নি। সাম্প্রতিক মিসর এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এজন্য জনগণ যে তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে এমনটি নাও হতে পারে; যেহেতু জনগণ দেখছে যে, তাদেরকে কাজ করতে দেয়া হচ্ছে না। অন্যদিকে নানা কৌশলে- কূটনৈতিক-রাজনৈতিক-সামরিক শক্তি প্রয়োগ এবং গণমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে তাদেরকে যারা পরাস্ত করতে চাইছে, তারা অতি মাত্রায় স্বৈরতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা চর্চা করছে; যদিও দৃশ্যত তারা গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা গ্রহণ করছে। এর উদাহরণ আমাদের চোখের সামনেই রয়েছে। এ বাস্তবতার নিরিখে বলা যায়, ইসলামপন্থীরা যদি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ পায়, তাহলে জনগণ হয়ত তাদেরকেই বার বার ভোট দেবে। তবে তার জন্য তাদের যেমন নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ পন্থায় রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক আন্দোলন নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যেতে হবে, তেমনি সমাজে উপস্থিত নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক সকল শক্তির এ ব্যাপারে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতে হবে।
উপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন এসে যায় যে, ইসলামপন্থীদের ক্ষমতায় বসানো হলে তারা সত্যিই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারবে কি? তারা যদি রাজনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে না পারে, তাহলে তাদের অবস্থাও স্বৈরশাসকদের মতই হবে। আর যদি তারা রাজনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তার সমূহ সম্ভাবনাও রয়েছে, সেক্ষেত্রে আরব ও মুসলিম বিশ্বে তাদের জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে যাবে। ইসলামপন্থীরা এ কাজ করতে পারবে কিনা তা নির্ভর করবে তারা কতটা সাফল্যের সাথে শরীয়া বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তুলতে পারবে- তার ওপর। বস্তুত একটি ইসলামী আইনসভা- হোক তা গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অথবা জুডিশিয়াল রিভিউ বা বিচারিক পর্যালোচনার ব্যবস্থা সম্বলিত, এরূপ একটি সাংবিধানিক ব্যবস্থার ওপরই তাদের সাফল্য নির্ভর করবে।
ফেল্ডম্যানের মতে, যে কোন দেশেই নির্বাহী বিভাগের হাতে যখন প্রচুর ক্ষমতা পুঞ্জিভূত থাকে, তখন তাকে আইনের শাসনের আওতায় নিয়ে আসার ব্যাপারটি সাংবিধানিক ব্যবস্থায় জটিল একটি বিষয় বলে পরিগণিত হয়। এজন্য কোনো কোনো জায়গায় পূর্ণাঙ্গ বিপ্লবের দরকার হয়। কোনো দেশের দুর্বল শাসকরা হয়ত তাদের বৈধতার জন্য আইনের শাসনের আওতায় আসতে সম্মত হবে। কিন্তু অধিকাংশ মুসলিম দেশেই বিপ্লবের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। এর বিপরীতে ক্রমান্বয়ে সংস্কারের কাজটি ইসলামপন্থীদের জন্য অধিকতর উপযুক্ত বলে মনে হয়। এর মাধ্যমে তারা ক্রমান্বয়ে ইসলামকে আইনগত কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে সক্ষম হবে। এর সাথে জুডিশিয়াল রিভিউর ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। যে কোন সমাজে শূন্যস্থানে আইন কার্যকর করা যায় না; এজন্য প্রয়োজন হয় মানবীয় প্রতিষ্ঠান এবং আইনের প্রতি মানুষের আস্থা এবং আইনের অনুশীলন। ক্লাসিক্যাল ইসলামী রাষ্ট্রে এ ধরনের পরিবেশ বিদ্যমান ছিল। বর্তমানে হয়ত সে অবস্থা পুরোপুরি ফিরিয়ে আনা যাবে না। তবে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে বিচারকদের জন্য ইসলামী আইন বিষয়ক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে এবং তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তবেই এ সব দেশে কিছুটা হলেও সে শূন্যতা পূরণ হবে বলে আশা করা যায়।
বিখ্যাত ইকনোমিস্ট পত্রিকা এই বইটি সম্পর্কে মন্তব্য করেছে যে, ‘ফেল্ডম্যান সাধারণ পাঠকদের জন্য এই ছোট ও হৃদয়গ্রাহী বইটিতে শত শত বছরের ইসলামী শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে তিনি আধুনিককালের রাজনৈতিক ইসলাম ও পুরনো ইসলামী শাসনব্যবস্থার পার্থক্যগুলোও চিহ্নিত করেছেন।’ ইকনোমিস্টের বিবেচনায় বইটি ২০০৮ সালের অন্যতম সেরা গ্রন্থ। বইটি BESTSELLER-এর পুরস্কারও জিতে নিয়েছে। বইটি প্রকাশ করেছে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস।
বইটির বঙ্গানুবাদ যে সহজ বিষয় নয় পাঠক মাত্রই তা স্বীকার করবেন। বিজ্ঞ অনুবাদক এটিকে সহজবোধ্য করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, সেই সাথে একাজে রিসার্চ সেন্টার ও এর বাইরেও একাধিক ব্যক্তিত্ব এটিকে সম্পাদনা করার ফলে বক্তব্য ও উপস্থাপন হৃদয়গ্রাহী হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানাই মোবারকবাদ, সেই সাথে কামনা করি উভয় জগতের তাদের মর্যাদাপূর্ণ জীবন।
এই বইটি অগ্রসর বাংলাভাষাভাষী পাঠকদের কাছে একটি নতুন চিন্তার উন্মেষ ঘটাবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। সবশেষে মহান রব্বুল আলামীনের শুকরিয়া আদায় করছি। মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাকে কবুল করুন। আমীন।
বিস্তারিত জানতে দেখুন-ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার পতন ও পুনরুত্থান-সূচিপত্র